বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

সৃষ্টি


অন্ধকারের ভেতর থেকে এক জোড়া চোখ তাকিয়ে আছেঅনেক মায়াবী শীতল চোখজায়গাটা কোথায় ঠিক খেয়াল হচ্ছে নাএকটা ঘন জঙ্গলচারপাশ জমাট  অন্ধকারশুধু চোখটার ওপর কে যেন অস্ফূট আলো ফেলেছেপথ ঠিক পরিচিত নয়চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করেতবে আস্তে আস্তে চোখ জোড়া যেন অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছেকোথায় যাচ্ছে?এত সুন্দর চোখ কি মানুষের হতে পারেদেখতে দেখতে নিমিষেই অন্ধকারে হারিয়ে গেল চোখ জোড়াআর কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না
একটা জোড়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে গা টা কেমন কাপুনি দিয়ে উঠল,তরতর করে গা ঘামতে লাগলঘুম ভেঙ্গে গেছেচোখ টোখ কিছু নয়নেহায়েত স্বপ্ন ছিল সবকিছুএমন স্ব্প্ন আগেও দেখেছে নিশিতবে কোন চোখ নয়কখনও বিড়াল,কখনও কুকুর আবার কখনও তেলাপোকা তারা করেছে স্বপ্নে প্রতিবার ঘুম ভেঙ্গে দেখা যায় বাইরে কোথাও দুইটা বিড়াল ঝগড়া বাধিয়েছে,নতুবা কুকুর হো হো করছে মাঝরাতে আর না হলে গায়ের ওপর তেলাপোকা আবিষ্কার করেছেআজ চোখ দেখার কোন কারণ বুঝতে পারল নাগা কেমন ছমছম করতে লাগলঘুম থেকে জেগেও এক প্রকার অস্বস্তি হতে থাকল নিশিরএখন কত রাত হবে?মাঝরাত?মাঝরাত ঠিক নয়শেষ রাত হবে হয়তঘড়ি দেখতে ইচ্ছে করছে নাঘড়ি আছে মাথার ঠিক ওপরেমাথা ঘুরিয়ে দেখতে হবে জানালার কাঁচের ফাঁক দিয়ে বাইরে চোখ পরতেই পেয়ারা গাছটার মাথায় চাঁদের স্নিগ্ধতা চোখে আটকা পরেপাতা থেকে থেকে একটু নড়ছেশেষ রাতেই এমন হয় কেবল পেটের মধ্যে কেমন একটা ব্যথা অনুভব হচ্ছেচিনচিনে ব্যথা নয় পেটের অনেকটা অংশ জুড়ে ব্যথাএমনটা আগেও হয়েছেতবে আজ ব্যথাটা ধীরে ধীরে বাড়ছেআস্তে আস্তে সারা শরীর অবসের মত হয়ে যাচ্ছেমাথাটা ফাকা ফাকা লাগছেআসিফ পাশে বেঘোরে ঘুমুচ্ছেতাকে ডাকলে হয়মুখ থেকে গোঙ্গানির মত বের হতে থাকলতারপর নিশির আর কিছু মনে নেইনিজেকে আবিষ্কার করল হাস্পাতালেতখনো পেটে অস্বাভাবিক ব্যথাট্রেসারে কয়েকজন তাকে নিয়ে যাচ্ছে অপারেশন থিয়েটারেতার এক ঘন্টা পর অপারেশন থিয়েটারের মধ্য থেকে অপরিচিত নতুন এক কন্ঠের তীব্র আর্তনাদে পুরো হাসপাতাল যেন কেঁপে উঠল
এইত কয়েকদিন আগের ঘটনানিশি একলা পুতুল খেলে যাচ্ছে তার সাজানো ঘরেবাবা মার একমাত্র আদরের মেয়ে নিশিসে কি জেদ তারতার খেলার ঘরে আর সবার প্রবেশ নিষেধতার কথাতেই পরিবারের বড়রা নিয়ত্রিত হচ্ছে
বাবা তুমি আজ অফিস থেকে তারাতারি আসবা কিন্তুময়না আজ শ্বশুরবাড়ি যাবেময়না হচ্ছে নিশির সাজানো পুতুল
যেই কথা সেই কাজকাজ ফেলে নিশির বাবাকে তারাতারি বাসায় এসে পুতুল খেলতে হয় মেয়ের সাথেএক দিন কি কারণে মেয়ের জন্য চকোলেট আনতে ভুলে গেলেনঅমনি হয়েছেনাওয়া নেই খাওয়া নেই সবার সাথে অভিমানসব পুতুল ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেলল মুহূর্তেইপরের দিন আবার পুতুল বানাতে বসলপুতুল ভাঙ্গা গড়া নিশির মন মর্জির ওপর নির্ভর করেএর আগেও অনেক বার ভেঙ্গেছেতখন তার সাথে কেউ কথা বলতে পারে না যেন এক অনাসৃষ্টির খেলানিশির কাছে পুতুল গুলোর একটা পৃথিবী আছেসে এই পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণকারীএখানে পুতুলের বিবাহ হয়,সন্তান প্রসব করে,তারা একে অপরের সাথে ঘর বাঁধেকারো বিয়োগে কেঁদে বুক ভাসায় নিশিতাদের দাফন কাফন করে তাদের জন্য দোয়া করতে ভোলে নাএই পৃথিবী শিশুমনের নিছক খেলা ছাড়া কিছুই নয়তবে এই খেলার মাঝে যেন একেকটা চরিত্র,একেক বন্ধন বিরাজ করে চলেছেমানব শিশু তার ধার ধারে কখন?
কোথায় গেল নিশির পুতুল খেলার সেই দিনগুলি?পড়ালেখায় মনোনিবেশ করতে করতে হটাৎ করে যেন বেড়ে উঠল সবার চোখ ফাকি দিয়েহটাৎ চোখে লাগার মত বেড়ে ওঠাএতদিন কেউ খেয়াল করেনি সেদিনের পুতুল পুতুল মেয়েটি আজ বড় হয়েছেযৌবনের আভায় উজ্জ্বল মুখে চোখে ভোরের আলোর মত দীপ্তি ছড়াতে থাকলযৌবনের সব দোষ গুনগুলি আস্তে আস্তে ধরা পরল পুতুল খেলায় মত্ত সেই পুতুলরূপী মানবশিশুর ওপরএক দিন বাবা কি যেন আলোচনা করছিলেন সবার সাথেনিশির ডাক পরলবাবা কি বললেন কিছুই মাথায় ঢুকল নাকি সব বড় বড় কথাসেদিনের নিশির কি এত বোঝার বয়স হয়েছে?হয়ত হয়েছেনা হলে সেদিন রাতে নিশি ঘুমুতে পারত কারো ধার না ধেরেএখন অনেক কিছু নিয়ে ভাবতে হয়
নিশির বিয়ে হল আসিফের সাথেআসিফ বাবার ব্যবসা দেখাশুনা করেধীরস্থির ছেলেকথা বলে খুব আস্তেছেলেটাকে নিশির খুব পছন্দ হয়ে গেলদুজন সংসার পাততে শুরু করলসত্য সংসারএই সংসারের নিয়ত্রণকর্তা সবার অগোচরে থাকেএখানে হাসি কান্নার জন্য কাউকে দায়ী করা চলে না
আসিফের সাথে নিশির বিবাহ সমাজের আর দশটা বিবাহের মতই অনুষ্ঠিত হয়েছিলকনে বিদায়ের সময় নিশির সাথে নিশির বাবা মাও কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলবাঙ্গালী মেয়েরা যেভাবে পুরোনো সম্পর্ক ছেদ করে নতুন স্থায়ী সম্পর্ক গরবার জন্য স্বামীর ঘরে আসে নিশির আসাটাও এর ব্যতিক্রম নয়এখানে অনেক মনস্তাত্বিক ক্রিয়া সংঘটিত হতে থাকেআমাদের গল্পের খাতিরে সেদিকে এখন মনোযোগ না দিলেও চলেনিশির দিন অতিবাহিত হচ্ছিল নতুন উৎসাহে,নতুন অভিজ্ঞতায়সকাল বেলা আসিফের খাবার তৈরি করে দিয়ে একটু পড়তে বসা,দুপুরের আগে আবার খাবার তৈরি করারাতে আসিফের সাথে সারাদিনের কর্ম আনন্দ ভাগাভাগি করাএভাবেই চলতে থাকে নিশির দিনগুলোএমনি বর্ষার এক সন্ধায় আসিফের পথ চেয়ে বসে আছে নিশিমনটা কেমন হয়ে আছেবৃষ্টি পরার শব্দে নিজেকে কোথাও লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করেনিজেকে খুঁজে পাওয়াও ভার হয়ে যায়সবকিছু হারিয়ে যেতে থাকেচিন্তা,চাঞ্চল্য আরো গুরুত্বপুর্ণ কিছু আবেগকারো আশ্রয়ে মাথা এলিয়ে দিতে মন চায়আসিফ ভিজতে ভিজতে বাসায় প্রবেশ করেকিছু পাওয়ার উৎসাহে মনটা যেন আবার চঞ্চল হয়ে ওঠে নিশিরবুকের ভেতর যেন ঠান্ডা এক টুকরো বরফ নিয়ে কে নারাচারা করেবাইরে থেকে কিছু দেখা যায় নাসেই বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায়
এই নশ্বর পৃথিবীর বুকে কোন ভেজা শব্দের পরিতৃপ্ত আস্রয়ে দুই নর নারীর নিশ্বাসের দ্বন্দ্ব বাধেকিছু সময় পৃথিবীর বুকে নেমে আসে স্বর্গের সুধাএই বর্ষার সন্ধ্যায় সেই সুধা গ্রহন করতে কত নরনারী ব্যস্ত থাকেতাদের সাথে আসিফ নিশি যুক্ত হলে ক্ষতি কি?
মানুষের জীবনে তো এমন অনেক সন্ধ্যা আসেসব সন্ধ্যা কি সমান ভাবে টানে?সমান ভাবে অনুভূতির দুয়ার খুলে দেয়
তার পরের ভোরের সূর্য কি সমান ভাবে আলো দেয়এমন সূর্য তো নিশি অনেক দেখেছেতবে আজকের আলো যেন বেশি চকচকেবেশি উজ্জ্বলনিশির সবকিছু ভাল লাগেআসিফ কে আরো বেশি ভাল লাগেতার কয়েক দিন পর থেকে নিশি এমন স্বপ্ন দেখে প্রতি রাতেহটাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে যায়তারপর শুরু হয় পেট ব্যথাকোন কোন দিন বমিও হয়েছেডাক্তার কি দেখায়নি নিশিলক্ষণ পরিচিতএতে ভয় পাবার কিছু নেইডাক্তাররা এমনটায় বলেতাই নিশি ভয় পায় নাতবে স্বপ্নে যখন পা মাটির সাথে বিধে যায় তখন কোথা থেকে যেন অদৃশ্য এক বোঝা এসে দম বন্ধ করে দেয়যেখানে ভয় পাবার কিছু নেই সেখানে কোথা থেকে যেন কি মনের মধ্যে এসে ভর করে
দিন অতিবাহিত হয়তলপেট ভারী হতে থাকেনিশি আয়নার সামনে দারিয়ে নিজেকে চিনতে ভুল করেকতদিন পুতুল খেলার ফাকে নিজেকে একজন আদর্শ মা ভেবেছেসন্তান ধারনের কত ইচ্ছা দিন দিন পোষণ করে আসছেআজ সত্যি নিশি মা হতে চলেছেতার ভেতরে আরেকজন মানুষ বসবাস করেতার শ্বাস প্রশ্বাস চলে নিশির মাধ্যমেতার শুন্য শরীর থেকে ছোট হাত পা এর ক্ষুদ্র নড়াচড়া পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপ নিশির অজ্ঞাতে হয় নানিশি আরেক টা জীবনের দায়ভার বহন করছেদিন দিন শারীরিক ভাবে নাজুক হয়ে পরলেও মনের মধ্যে আসে এক নতুন ভাললাগাঅভিভাবকত্বের নতুন আকাঙ্খাএই আকাঙ্খা আর ভাললাগা এক দিন পরিনত হয় মাতৃস্নেহেনিজেকে মা মনে হয় নিশির
অপারেশন থিয়েটারে ক্ষুদ্র এক নবজাতক মিটিমিটি তাকিয়ে গলাছেড়ে চিৎকার দিয়ে যাচ্ছেনিশি তার গালের কাছে নিয়ে নবজাতকটির নিশ্বাসের শব্দ শোনার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠলতার কাছে পৃথিবীর আর সবকিছু তুচ্ছ মনে হলএই নিশ্বাস তার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ট সম্পদএই নিশ্বাস কে সে ধীরে ধীরে আগলে নিরাপত্না দিয়ে এসেছেতাকে স্বাধীন করে নিজ দেহ থেকে আলাদা করেছেসেদিনের বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যার চাঞ্চল্য মিশে আছে এই নিশ্বাসেতার চিৎকার করা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করেতার চোখ জোড়া বড় বেশি ব্যকুল করেএমন চোখের দীপ্তি নিশি কখনও দেখেনিহয়ত দেখেছে অপরিচিত কোন এক জঙ্গলের অন্ধকারে। 

২১/০৯/২০১৪, রাজশাহী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন