অন্ধকারের ভেতর থেকে এক জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে।অনেক মায়াবী শীতল চোখ।জায়গাটা কোথায় ঠিক খেয়াল হচ্ছে না।একটা ঘন জঙ্গল।চারপাশ জমাট অন্ধকার।শুধু চোখটার ওপর কে যেন অস্ফূট আলো ফেলেছে।পথ ঠিক পরিচিত নয়।চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।তবে আস্তে আস্তে চোখ জোড়া যেন অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে।কোথায় যাচ্ছে?এত সুন্দর চোখ কি মানুষের হতে পারে।দেখতে দেখতে নিমিষেই অন্ধকারে হারিয়ে গেল চোখ জোড়া।আর কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।
একটা জোড়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে গা টা কেমন কাপুনি দিয়ে উঠল,তরতর করে গা ঘামতে লাগল।ঘুম ভেঙ্গে গেছে।চোখ টোখ কিছু নয়।নেহায়েত স্বপ্ন ছিল সবকিছু।এমন স্ব্প্ন আগেও দেখেছে নিশি।তবে কোন চোখ নয়।কখনও বিড়াল,কখনও কুকুর আবার কখনও তেলাপোকা তারা করেছে স্বপ্নে। প্রতিবার ঘুম ভেঙ্গে দেখা যায় বাইরে কোথাও দুইটা বিড়াল ঝগড়া বাধিয়েছে,নতুবা কুকুর হো হো করছে মাঝরাতে আর না হলে গায়ের ওপর তেলাপোকা আবিষ্কার করেছে।আজ চোখ দেখার কোন কারণ বুঝতে পারল না।গা কেমন ছমছম করতে লাগল।ঘুম থেকে জেগেও এক প্রকার অস্বস্তি হতে থাকল নিশির।এখন কত রাত হবে?মাঝরাত?মাঝরাত ঠিক নয়।শেষ রাত হবে হয়ত।ঘড়ি দেখতে ইচ্ছে করছে না।ঘড়ি আছে মাথার ঠিক ওপরে।মাথা ঘুরিয়ে দেখতে হবে। জানালার কাঁচের ফাঁক দিয়ে বাইরে চোখ পরতেই পেয়ারা গাছটার মাথায় চাঁদের স্নিগ্ধতা চোখে আটকা পরে।পাতা থেকে থেকে একটু নড়ছে।শেষ রাতেই এমন হয় কেবল। পেটের মধ্যে কেমন একটা ব্যথা অনুভব হচ্ছে।চিনচিনে ব্যথা নয় পেটের অনেকটা অংশ জুড়ে ব্যথা।এমনটা আগেও হয়েছে।তবে আজ ব্যথাটা ধীরে ধীরে বাড়ছে।আস্তে আস্তে সারা শরীর অবসের মত হয়ে যাচ্ছে।মাথাটা ফাকা ফাকা লাগছে।আসিফ পাশে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে।তাকে ডাকলে হয়।মুখ থেকে গোঙ্গানির মত বের হতে থাকল।তারপর নিশির আর কিছু মনে নেই।নিজেকে আবিষ্কার করল হাস্পাতালে।তখনো পেটে অস্বাভাবিক ব্যথা।ট্রেসারে কয়েকজন তাকে নিয়ে যাচ্ছে অপারেশন থিয়েটারে।তার এক ঘন্টা পর অপারেশন থিয়েটারের মধ্য থেকে অপরিচিত নতুন এক কন্ঠের তীব্র আর্তনাদে পুরো হাসপাতাল যেন কেঁপে উঠল।
এইত কয়েকদিন আগের ঘটনা।নিশি একলা পুতুল খেলে যাচ্ছে তার সাজানো ঘরে।বাবা মার একমাত্র আদরের মেয়ে নিশি।সে কি জেদ তার।তার খেলার ঘরে আর সবার প্রবেশ নিষেধ।তার কথাতেই পরিবারের বড়রা নিয়ত্রিত হচ্ছে।
বাবা তুমি আজ অফিস থেকে তারাতারি আসবা কিন্তু।ময়না আজ শ্বশুরবাড়ি যাবে।ময়না হচ্ছে নিশির সাজানো পুতুল।
যেই কথা সেই কাজ।কাজ ফেলে নিশির বাবাকে তারাতারি বাসায় এসে পুতুল খেলতে হয় মেয়ের সাথে।এক দিন কি কারণে মেয়ের জন্য চকোলেট আনতে ভুলে গেলেন।অমনি হয়েছে।নাওয়া নেই খাওয়া নেই সবার সাথে অভিমান।সব পুতুল ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেলল মুহূর্তেই।পরের দিন আবার পুতুল বানাতে বসল।পুতুল ভাঙ্গা গড়া নিশির মন মর্জির ওপর নির্ভর করে।এর আগেও অনেক বার ভেঙ্গেছে।তখন তার সাথে কেউ কথা বলতে পারে না। যেন এক অনাসৃষ্টির খেলা।নিশির কাছে পুতুল গুলোর একটা পৃথিবী আছে।সে এই পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণকারী।এখানে পুতুলের বিবাহ হয়,সন্তান প্রসব করে,তারা একে অপরের সাথে ঘর বাঁধে।কারো বিয়োগে কেঁদে বুক ভাসায় নিশি।তাদের দাফন কাফন করে তাদের জন্য দোয়া করতে ভোলে না।এই পৃথিবী শিশুমনের নিছক খেলা ছাড়া কিছুই নয়।তবে এই খেলার মাঝে যেন একেকটা চরিত্র,একেক বন্ধন বিরাজ করে চলেছে।মানব শিশু তার ধার ধারে কখন?
কোথায় গেল নিশির পুতুল খেলার সেই দিনগুলি?পড়ালেখায় মনোনিবেশ করতে করতে হটাৎ করে যেন বেড়ে উঠল সবার চোখ ফাকি দিয়ে।হটাৎ চোখে লাগার মত বেড়ে ওঠা।এতদিন কেউ খেয়াল করেনি সেদিনের পুতুল পুতুল মেয়েটি আজ বড় হয়েছে।যৌবনের আভায় উজ্জ্বল মুখে চোখে ভোরের আলোর মত দীপ্তি ছড়াতে থাকল।যৌবনের সব দোষ গুনগুলি আস্তে আস্তে ধরা পরল পুতুল খেলায় মত্ত সেই পুতুলরূপী মানবশিশুর ওপর।এক দিন বাবা কি যেন আলোচনা করছিলেন সবার সাথে।নিশির ডাক পরল।বাবা কি বললেন কিছুই মাথায় ঢুকল না।কি সব বড় বড় কথা।সেদিনের নিশির কি এত বোঝার বয়স হয়েছে?হয়ত হয়েছে।না হলে সেদিন রাতে নিশি ঘুমুতে পারত কারো ধার না ধেরে।এখন অনেক কিছু নিয়ে ভাবতে হয়।
নিশির বিয়ে হল আসিফের সাথে।আসিফ বাবার ব্যবসা দেখাশুনা করে।ধীরস্থির ছেলে।কথা বলে খুব আস্তে।ছেলেটাকে নিশির খুব পছন্দ হয়ে গেল।দুজন সংসার পাততে শুরু করল।সত্য সংসার।এই সংসারের নিয়ত্রণকর্তা সবার অগোচরে থাকে।এখানে হাসি কান্নার জন্য কাউকে দায়ী করা চলে না।
আসিফের সাথে নিশির বিবাহ সমাজের আর দশটা বিবাহের মতই অনুষ্ঠিত হয়েছিল।কনে বিদায়ের সময় নিশির সাথে নিশির বাবা মাও কেঁদে বুক ভাসিয়েছিল।বাঙ্গালী মেয়েরা যেভাবে পুরোনো সম্পর্ক ছেদ করে নতুন স্থায়ী সম্পর্ক গরবার জন্য স্বামীর ঘরে আসে নিশির আসাটাও এর ব্যতিক্রম নয়।এখানে অনেক মনস্তাত্বিক ক্রিয়া সংঘটিত হতে থাকে।আমাদের গল্পের খাতিরে সেদিকে এখন মনোযোগ না দিলেও চলে।নিশির দিন অতিবাহিত হচ্ছিল নতুন উৎসাহে,নতুন অভিজ্ঞতায়।সকাল বেলা আসিফের খাবার তৈরি করে দিয়ে একটু পড়তে বসা,দুপুরের আগে আবার খাবার তৈরি করা।রাতে আসিফের সাথে সারাদিনের কর্ম আনন্দ ভাগাভাগি করা।এভাবেই চলতে থাকে নিশির দিনগুলো।এমনি বর্ষার এক সন্ধায় আসিফের পথ চেয়ে বসে আছে নিশি।মনটা কেমন হয়ে আছে।বৃষ্টি পরার শব্দে নিজেকে কোথাও লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে।নিজেকে খুঁজে পাওয়াও ভার হয়ে যায়।সবকিছু হারিয়ে যেতে থাকে।চিন্তা,চাঞ্চল্য আরো গুরুত্বপুর্ণ কিছু আবেগ।কারো আশ্রয়ে মাথা এলিয়ে দিতে মন চায়।আসিফ ভিজতে ভিজতে বাসায় প্রবেশ করে।কিছু পাওয়ার উৎসাহে মনটা যেন আবার চঞ্চল হয়ে ওঠে নিশির।বুকের ভেতর যেন ঠান্ডা এক টুকরো বরফ নিয়ে কে নারাচারা করে।বাইরে থেকে কিছু দেখা যায় না।সেই বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায়
এই নশ্বর পৃথিবীর বুকে কোন ভেজা শব্দের পরিতৃপ্ত আস্রয়ে দুই নর নারীর নিশ্বাসের দ্বন্দ্ব বাধে।কিছু সময় পৃথিবীর বুকে নেমে আসে স্বর্গের সুধা।এই বর্ষার সন্ধ্যায় সেই সুধা গ্রহন করতে কত নরনারী ব্যস্ত থাকে।তাদের সাথে আসিফ নিশি যুক্ত হলে ক্ষতি কি?
মানুষের জীবনে তো এমন অনেক সন্ধ্যা আসে।সব সন্ধ্যা কি সমান ভাবে টানে?সমান ভাবে অনুভূতির দুয়ার খুলে দেয়।
তার পরের ভোরের সূর্য কি সমান ভাবে আলো দেয়।এমন সূর্য তো নিশি অনেক দেখেছে।তবে আজকের আলো যেন বেশি চকচকে।বেশি উজ্জ্বল।নিশির সবকিছু ভাল লাগে।আসিফ কে আরো বেশি ভাল লাগে।তার কয়েক দিন পর থেকে নিশি এমন স্বপ্ন দেখে প্রতি রাতে।হটাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে যায়।তারপর শুরু হয় পেট ব্যথা।কোন কোন দিন বমিও হয়েছে।ডাক্তার কি দেখায়নি নিশি।লক্ষণ পরিচিত।এতে ভয় পাবার কিছু নেই।ডাক্তাররা এমনটায় বলে।তাই নিশি ভয় পায় না।তবে স্বপ্নে যখন পা মাটির সাথে বিধে যায় তখন কোথা থেকে যেন অদৃশ্য এক বোঝা এসে দম বন্ধ করে দেয়।যেখানে ভয় পাবার কিছু নেই সেখানে কোথা থেকে যেন কি মনের মধ্যে এসে ভর করে ।
দিন অতিবাহিত হয়।তলপেট ভারী হতে থাকে।নিশি আয়নার সামনে দারিয়ে নিজেকে চিনতে ভুল করে।কতদিন পুতুল খেলার ফাকে নিজেকে একজন আদর্শ মা ভেবেছে।সন্তান ধারনের কত ইচ্ছা দিন দিন পোষণ করে আসছে।আজ সত্যি নিশি মা হতে চলেছে।তার ভেতরে আরেকজন মানুষ বসবাস করে।তার শ্বাস প্রশ্বাস চলে নিশির মাধ্যমে।তার শুন্য শরীর থেকে ছোট হাত পা এর ক্ষুদ্র নড়াচড়া পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপ নিশির অজ্ঞাতে হয় না।নিশি আরেক টা জীবনের দায়ভার বহন করছে।দিন দিন শারীরিক ভাবে নাজুক হয়ে পরলেও মনের মধ্যে আসে এক নতুন ভাললাগা।অভিভাবকত্বের নতুন আকাঙ্খা।এই আকাঙ্খা আর ভাললাগা এক দিন পরিনত হয় মাতৃস্নেহে।নিজেকে মা মনে হয় নিশির।
অপারেশন থিয়েটারে ক্ষুদ্র এক নবজাতক মিটিমিটি তাকিয়ে গলাছেড়ে চিৎকার দিয়ে যাচ্ছে।নিশি তার গালের কাছে নিয়ে নবজাতকটির নিশ্বাসের শব্দ শোনার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠল।তার কাছে পৃথিবীর আর সবকিছু তুচ্ছ মনে হল।এই নিশ্বাস তার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ট সম্পদ।এই নিশ্বাস কে সে ধীরে ধীরে আগলে নিরাপত্না দিয়ে এসেছে।তাকে স্বাধীন করে নিজ দেহ থেকে আলাদা করেছে।সেদিনের বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যার চাঞ্চল্য মিশে আছে এই নিশ্বাসে।তার চিৎকার করা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।তার চোখ জোড়া বড় বেশি ব্যকুল করে।এমন চোখের দীপ্তি নিশি কখনও দেখেনি।হয়ত দেখেছে অপরিচিত কোন এক জঙ্গলের অন্ধকারে।
২১/০৯/২০১৪, রাজশাহী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন