শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

পদ্মা নদী ও কিছু গল্প

পদ্মা নদী 


-চল আজ চলে যাই।সন্ধ্যা হলে আর এখানে ভালো লাগেনা।
বন্ধু আতিকের একটা নিত্য উক্তি।সারাদিন হলে বসে থেকে বিকেলে যখন বের হই তখন কেউ খুঁজে পাইনা কোথায় যাব।অবশেষে হাঁটতে হাঁটতে সেই চিরচেনা পদ্মার পাড়ে অজান্তেই গিয়ে বসি।সূর্য হাতের ডান দিকে সোজা গিয়ে ডুবিডুবি করে ডুবে যায়।বসে থাকতে থাকতেই অন্ধকার নেমে আসে।সাথে আসে মশারাও।গরমের দিন হলে তো কথায় নেই।রাজশাহী শহরে গরমের দিনে জাহান্নামের একটা দরজা খুলে দেওয়া হয়।চারিদিকে ভ্যাপসা গরম শুরু হয়ে যায়।বসে আছি আর ঘামছি।বাতাসের নাম গন্ধ নাই।ঘেমে যখন চিটচিটে তখন আতিক উক্ত কথাটি বলবে।কথাটি সত্য।সন্ধ্যা হলে যেন নদীর রূপ পরিবর্তন হয়ে যায়।নৌকা যেসব চলছিল সেগুলো থেমে যায়।মানুষজন ধীরে ধীরে চলে যেতে থাকে।সবকিছু মিলিয়ে একটা ভাঙ্গার অনুভূতি।ছোটবেলায় গ্রামের পাশে মেলা হত।তিন দিন জমজমাট মেলার পর যখন দোকান পাট উঠে যেতে শুরু করত,গ্রাম থেকে সকল আত্মীয়রা চলে যেত।স্তিমিত হতে থাকত মানুষের কোলাহল।তখন খুব মন খারাপ হত।সেই যে অনুভূতি।ঠিক ততটা না হলেও একটা ভাঙ্গার অনুভূতি আমাদের অবচেতন মনকে বিকল করে।আমাদের মন খারাপ করে দেয়।নদীর ধারের এই ছোট্ট ভাঙ্গা গড়াও আমাদের অনুভূতির বাইরে নয়।আমরা চলে আসি।পরেরদিন আবার যাই।আবার মন খারাপ করে চলে আসি।আমাদের যে যেতেই হবে।মন খারাপ করতেই হবে।সম্পর্কটা যে একদিনের নয়।
শান্ত ভাই নামে একজন গান পাগল আসল আমাদের বাসায়।সে গান ছাড়া কিছু করেনা।কি খাচ্ছে কোথায় থাকছে তার হুঁশ নেই।প্রায় প্রতিরাতে গানের আসর বসছে নদীর ধারে। জৈষ্ঠ্যের তীব্র গরমে নদীর বুকে হাহাকার করা অনুভূতি।একবুক পানি। হাতে গিটার নিয়ে একের পর এক গান গেয়ে যাচ্ছে।আমরা খালি গায়ে হাতে তালি দিয়ে গানের তালে তালে দুলছি।
“মনও দিল না বধু,মনও নিলো যে শুধু ,আমি কি নিয়ে থাকি”
গান শেষ।প্রায় মধ্যরাত।নদীর পার থেকে মাঝখানের পানি কিছুটা দূরে।আমরা পানির খুব কাছাকাছি বসে আছি।হটাৎ শাব্বির কিছু না বলে নদীতে দিল ঝাপ।তারপর একে একে সবাই।যারা সাঁতার পারত না তাঁরাও শুধুমাত্র মনের জোরে।নদীর এপার থেকে ওপারে চলে গেলাম।মাঝ নদীতে একগলা পানি।তারপর ধু ধু করা চর।আকাশে আধঘানা চাদ।ওপারে কি আছে আমরা তখন কিছুই জানিনা।অজানার সাহস আমাদের পেয়ে বসেছিল।গলা ছেড়ে চিৎকার দিচ্ছি ইচ্ছামত।যে যার ভালো লাগার মানুষের নাম ধরে চিৎকার দিচ্ছি।চর থেকে গড়ানি দিয়ে নদীতে গিয়ে পরছি।সারা গা বালিতে মাখামাখি।তারপর আবার নদী পার হয়ে এপার এসেই আমরা হতবাক।কিছু লোক হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ভয়ভয় করতে লাগল।তবুও মনে একটাই সাহস আমরা রুয়েটে পরি।আর যাইহোক একটা সম্মান তো আছে।ওনাদের সাথে কথা বলে যা বুঝতে পারলাম আমাদের চিল্লাপাল্লা শুনে ওনারা ভেবে নিয়েছিল নদীর ধারে কেউ মানুষ খুন করছে।  তারা তাকে বাঁচাতে এসেছে।কেউ খুন হয়নি বলে ওনারা হতাস হয়ে চলে গেলেন পিছে পিছে আমরাও।
কারো জন্মদিন? রাতে মাস্টার শেফে খাওয়া দাওয়া করে চলে যাই নদীর ধারে।বারটা বাজার ঠিক আগে আগে কেক কাটি।পদ্মা গার্ডেন তখন শুনশান।কিছু কুকুর শুয়ে থাকে।হ্যাপি বার্থডে টু ইউ চিৎকার শুনে তারা দুই একবার তাকায়।আবার ঘুমিয়ে পরে।সারাদিনের সব ফুচকার দোকান এই সময় বন্ধ থাকে।সামনে যা থাকে তা শুধু নদী।গরম আর শীতের দিনে ধু ধু করা চর আর বর্ষাকালে অথয় পানি আর তার কুলু কুলু আওয়াজ।চাঁদ থাকলে পানি দেখতে গলিত রূপার মত লাগে।কোথাও পানির পাকে চাঁদের আলো কুচিকুচি হয়ে পাক খেতে খেতে চলে যায় দৃষ্টির বাইরে।হালকা হালকা বাতাস বয়।এই বাতাসের গন্ধ অন্যরকম।পানির একটা স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধের সাথে অজানা এক গন্ধ এসে মিলিত হয়।কেক কাটার পরে গোলচত্ত্বরে বসে আড্ডা হয়।কেউ গান গায়।কেউ ঝিম ধরে থাকে সিগারেট খায় কেউ নদীর ধারে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে থাকে কেউ একটু দূরে গিয়ে প্রিয়জনের সাথে কথা বলে আবার কেউ অতীত নিয়ে কথা বলে।নিজেদের নিয়ে কথা বলি।পাওয়া না পাওয়ার কথা মুখ্য হয়ে ওঠে।ইয়ার্কি করতে করতে পরিবেশ থমথমে হয়ে যায় আবার কাউকে পঁচানি দিয়ে আবার হালকা হয়। সবাই যখন চুপ হয়ে যায় তখন হলে ফেরার সময় হয়।কেউ একবার বললেই হল
-চল আজ উঠি
সবাই হেলে দুলে হলের দিকে ফিরতে থাকি।
বর্ষা কাল নয় তবুও কয়েকদিন ধরে সারাদিন বৃষ্টি হচ্ছে আবার থেমে যাচ্ছে। উথাল পাথাল হাওয়া বইছে।দুপুরে সবাই ঘুম।আমার মন ভালো নেই।মাঝে মাঝে মনটা খুব উদাস হয়ে যায় এমন পরিবেশে।ঘরে মন টেকে না।আবার কোথাও যাব তাও খুঁজে পাইনা।কেউ সাথে থাকবে সেটাও ভালো লাগেনা আবার একলা যাব তাও মন টানেনা।তখন যতি দার সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম তার মনেরও একি অনুভূতি।কি আর করা।বৃষ্টি থেমে গিয়ে তখন আকাশ পরিষ্কার।হাওয়া দিচ্ছে মাতাল করা।এই হাওয়া খেয়েই মনে হয় হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন “মাতাল হাওয়া” উপন্যাস খানা।আমি আর যতি দা পাঞ্জাবী পরে বের হলাম।উথাল পাথাল বাতাসে চাপা কাপড় চোপর ভালো লাগে না।পদ্মা গার্ডেন থেকে নদীর পার ধরে হাঁটা শুরু করলাম।নদীর ধারে বড় বড় কাশফুলের ফুলবিহীন গাছ হাওয়ায় দুলছে ।আমরা হাঁটছি আর মুখে মুখে ছড়া কাঁটছি।যতি দা গান বানাচ্ছে।অসংখ্য অলিখিত ছড়া আর গান সেদিন নদীর ধারেই বৈরী হাওয়ায় ভেসে থাকল।কে জানে হয়ত এই হাওয়ায় আরো কত ছড়া গান ভেসে আসছে দূর অজানা থেকে,যুগ যুগান্তর থেকে।সন্ধ্যা হয় হয় মন তবু শান্ত হয় না।মেঘের ফাক দিয়ে অস্তগামী সূর্‍্য আলোক রশ্নি ছড়িয়ে যাচ্ছে।দূরে কোন এক লোকালয়ে সেই আলোক রশ্নি পরছে।দৃশ্যটা চেয়ে দেখার মত।তারপরেও এইরকম রশ্নি দেখেছি বহুবার।কিন্তু সেই যে একটা অনুভূতি যতবারই দেখি সেই সময়টার কথা মনে হয়।নতুন অনুভূতির সাথে পুরাতনের সেই রশ্নি আরো প্রাঞ্জল হয়ে মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করতে থাকে।
সুপার মুন।রুয়েট এস্ট্রোনমিকাল সোসাইটি চাঁদ দেখার আয়োজন করেছে রুয়েট খেলার মাঠে।দাঁড়িয়ে আছি দূরবিন দিয়ে চাঁদের গায়ের কলঙ্ক দেখব।যাকি ভাই এর ফোন।পদ্মা গার্ডেনে চলে আয়।আজ চন্দ্র বিলাস হবে নদীতে।খুব ভাললাগার দুইজন বড়ভাই যাকি ভাই আর হিরা ভাই সহ আমরা সাতজন একটা নৌকা ভাড়া করে পূব দিকে যাত্রা শুরু করলাম।ততদিনে পশ্চিম দিকে যত দূর যাওয়া যায় ততদূর দেখা হয়ে গেছে।পূব দিকে এর আগে যাওয়া হয়নি।আকাশে সুপার মুন।নদী আর তার ধু ধু করা চর প্রায় ঘন্টা দুয়েক নৌকা চলল।আমার শার্ট খুলে মাথায় বেঁধেছি।গলা ছেড়ে গান গাইছি।নৌকার ইঞ্জিনের শব্দে গান আর কেউ শুনতে পাচ্ছেনা।নিজে গাচ্ছি নিজেই শুনছি।যে যার মনে উদাস হয়ে বসে আছে।কেউ গলুইয়ে, কেউ নৌকার মাঝখানে চিৎ হয়ে শুয়ে।চেয়ে আছি দূর চরের দিকে।পূর্ণিমার আলো চরের বালির ওপর খেলা করছে।আধো আলো আধো ছায়ার খেলা।চারপাশ জনশুন্য।নদীর মাঝখানে একটা নৌকা আর তার পাশে চাঁদের আলোর অপরূপ লীলা।সময়টা বয়ে যাচ্ছে।জীবনের কিছু সময় মনে হয় সময়টা থেমে থাক।এই চাঁদের আলো এই নদী এই চর একটা ফ্রেমে বাঁধা থাক।যেখানে সময় একটা শব্দ মাত্র।এই একই ফ্রেমে সময়টাও বাঁধা থাক।
সারদার কাছাকাছি বড় নদী।চরের দুই পাশ থেকে দুইটা শাখা এসে এখানে মিলিত হয়েছে।যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি।চাদের আলোয় পানির রঙ রূপালী।গলিত রূপা এই নশ্বর পৃথিবীর বুকে একটা ছন্দে বয়ে চলেছে যেন।মাঝ নদীতে নৌকা থামল।পানির গভীরতা কম।দিলাম ঝাপ।একে একে সবাই।যাকি ভাইও বাদ পরল না। ভয়াল নদীকে গায়ে মাখলাম।নিজের মত করে নদীকে অঙ্গে ধারণ করলাম কখনও নৌকা থেকে লাফ দিয়ে কখনও ডুব দিয়ে।কখনোও ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে আকাশের দিকে মুখ করে।ঝাপা ঝাপি শেষ।রাত হয়ে গেছে ভালই।ফিরতে হবে।সবাই উঠলাম।যাকি ভাই কে নিয়ে হল বিড়ম্বনা।একশো চার কেজি ওজনের একটা জীবকে কিভাবে জ্যান্ত এককোমর পানি থেকে নৌকায় তোলা হবে এই চিন্তায় তখন বড় হয়ে উঠল।তারপর যারা নৌকায় উঠেছিলাম একে একে সবাই নামলাম।সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের প্রিয় মানুষ যাকি ভাই কে নৌকায় তুলতে সমর্থ হলাম।যাওয়ার সময়ে যে অনুভূতি ছিল ফেরার সময়ের অনুভূতি তার বিপরীত।ভেজা গায়ে আর কিছু ভালো লাগছে না। কখন পারে পৌছাব এই ভাবনায় তখন মূখ্য।
এইরকম অসংখ্য গল্প জড়িয়ে আছে প্রিয় পদ্মা নদীকে ঘিরে।আমাদের অসংখ্য ব্যথা অসংখ্য সুখের মূহুর্ত গুলো পদ্মা মা আগলে রেখেছিল পাঁচটি বছর ধরে।নদীর ধারে গিয়ে যখনই বলেছি আমার আজ মন ভালো নেই।তখন পদ্মায় ভেঁসে উঠত একটা মুখ।আমি তখন আর কিছু দেখতাম না।অস্ত আকাশ জূড়ে নদীর ওপারে সেই মুখের দিকে তাঁকিয়ে শুধু হাঁসতাম।নদীর কাছে গিয়ে যখন বলেছি আমি নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি কাছের সবাই হারিয়ে যাচ্ছে।তখন পদ্মা আমাকে দৃষ্টির সীমানায় হারিয়ে নিয়ে গেছে।যেখানে কাউকে প্রয়োজন নেই।অচেনা অজানা জগতে যেখানে  শুধু আমি একা।একটা পৃথিবী।নদীর ধারে বসলেই শুদ্ধ চিন্তা করতে পারতাম।সাহস পেতাম বুকে।
রাজশাহী ছাড়ার কিছুদিন আগে তালাইমারি নদীর পারে একটা জায়গা আবিষ্কার করলাম।নদীর শুকনা পারে একটা পরিত্যক্ত ট্রলার।সেটাই হল নদীর ধারে আমাদের শেষ কয়টা দিনের আড্ডাস্থল।সময় পেলেই সেই ট্রলারে গিয়ে বসতাম।উথাল পাথাল বাতাসে গত পাঁচ বছরের স্মৃতি চারণ করতে করতে দিনগুলো পার হত।কৈশোর থেকে যৌবনের উল্লেখযোগ্য সময়।সময়ের পরিবর্তন,অনুভুতির পরিবর্তন,চিন্তার গাঢ়ত্ব সবকিছুর সাক্ষী এই নদী।এই নদীর পারে যেই মুখগুলো বসে জীবনের হিসেব করতাম একে একে হারিয়ে যাচ্ছে সবাই।হারিয়ে যাচ্ছি আমি।নদীর ধারের সেই মুখগুলো একসাথে বসে আর গালি নিষিদ্ধ করণ বোর্ডের মিটিং করব না।একটা গালির বিনিময়ে এক টাকা আর কেউ দিব না।আর কেউ বলব না কাল সিটি আছে চল আজ উঠি।সময় চলে যায় স্মৃতি পরে থাকে।অসংখ্য গল্প পদ্মা নামের স্রোতেই ভাসতে থাকে।মাঝে মাঝে আসে গল্প হয়ে।যান্ত্রিক জীবনের নাভিশ্বাসের ফাকে এক টুকরো হাসি হয়ে।

০৪/০৩/২০১৭, ঢাকা 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন