শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

বিকেলের মেঘ


বিকেলের এই সময়টা কাটতে চায়না যেন।সারাদিন ক্লাস,আইটেম শেষে বাসায় ফিরে মুখে পানির ঝাপ্টা দেয়ার সাথে সাথে মনে হয় সবকিছু থেমে গেছে।সারাদিনের ব্যস্ততা নিমিষেই জমাট বেঁধে এক ধ্রুব সমাপ্তির দিকে অগ্রসর হচ্ছে।যে সমাপ্তি মন্থর। সমাপ্তির প্রক্রিয়াও যেন চলছে অনন্তকাল ধরে।সারাদিন এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করে মৌ কিন্তু এই সময়টায় সবচেয়ে একঘেয়ে কাটে তার।একসাথে অনেক কিছু করতে ইচ্ছে করে কিন্তু কোন কাজই আর গুছিয়ে করা হয় না।শেষমেষ প্রতিদিনের একই রুটিন মাফিক আজোও বারান্দায় এসে খাঁচার ময়নাটির সাথে কিছু আবোল তাবোল কথোপকথন চলে ।মৌ ময়নাটিকে কথা শেখায়।আসিফ ময়নাটি কিনে দিয়েছিল তিন বছর আগে।ময়নাটি তখন অনেক ছোট ছিল।কিছুই বলতে পারত না।আসিফ বলেছিল এটা কথা বলা পাখি ওকে যা শেখানো হবে তাই হুবহু নকল করে বলবে।প্রায় একবছর হয়ে গেল কিন্তু পাখিটি মৌ ছাড়া আর কিছুই বলতে পারে না।তাও সবসময় বলে না।যখন তার মন মর্জি হয় শুধু তখন।পাখির কন্ঠে নিজের নাম শুনতে খারাপ লাগে না।কেমন নাকের মধ্যে থেকে বলে  ওঠে “মৌঁ”।
-এই বল আমার নাম কি?
পাখি খাঁচার মধ্যে ছটফট করতে থাকে।লোহার শিক কামড়ে ওপরে ঝুলে থাকে।তার এই ছটফটানি বেশিক্ষন ভাল লাগে নাপাখির কাছ থেকে একটু সরে মৌ বারান্দার রেলিং ধরে দাঁরায়।পাশে ঘিঞ্জির মত অনেক বাড়ি আর গাছপালা থাকার কারণে আকাশটাও ভালমত দেখা যায় না।তবে যতটুকু আকাশ দেখা যাচ্ছে সেখানে একখন্ড মেঘ জমে আছে।বিকেলের আকাশে মেঘ থাকলে আকাশটা অন্যরকম লাগে।চারপাশের প্রকৃতি হলুদাভ হয়ে যায়।প্রকৃতির কোন পরিবর্তনই মৌ এর মনে প্রভাব ফেলে না।তার মনে আবেগের প্রস্রয় নেই।তবুও এই সময়টায়,এই বিকেলটায় তাকে কেমন এলোমেলো করে দেয়।আজেবাজে চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।চিন্তাগুলো নিতান্তই যে আজেবাজে তেমনটা নয়।সূর্য অস্ত গেলে তার এই অবসরেরও অস্ত হবে।তাকে পড়ার টেবিলে বসতে হবে পরের আইটেম এর জন্য।আইটেম গুলো তার জীবনের কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে।এগুলো থেকে নিস্তার পাওয়ার কোন পথ নেই।ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে হলে এই আইটেম গুলোও তাকে উত্তীর্ণ হতে হবে।তবু মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন থেকেই যায় ,ডাক্তার হলেই কি সব শেষ?তারপর আবার বৃহত্তর জীবন।আরো একঘেয়ে বিস্তৃত জীবন।চোখ বন্ধ করে সেই জীবনটার কথা ভাবলে অন্ধকার হয়ে আসে চারপাশ। রেলিং ধরে মৌ আকাশের দিকে তাকায় আবার।খাঁচার পাখিটার মত তার মনের মধ্যে যে এক পাখি বাস করে সেও যেন লোহার সেই শক্ত রেলিং এর শিক কামড়ে ধরে ।এই চিরন্তন পরিচিত বারান্দা।জন্মের পর থেকে এইটুকুই তার মুক্ত বাতাস নেওয়ার একমাত্র স্থান।ছোটবেলার ছোট নিশ্বাস এই বারান্দায় মুক্ত ভাবে বিচরণ করত কিন্তু আজ সে নিশ্বাস দীর্ঘশ্বাস এ পরিনত হয়েছে।এখন তার দীর্ঘশ্বাস এই ছোট্ট বারান্দায় সংকুলান হয়।গুমোট বাতাস যেন ঘুরেফিরে আবার তার চারপাশটা আবদ্ধ করে রাখে।দিনদিন এই বাতাস গুলোও যেন নিজের নিশ্বাসে দূষিত হচ্ছে।এই পরিচিত গুমোট বাতাস আর নিতে ইচ্ছে করে না।এইত তিন বছর।তিন বছর আগেই সবকিছু অন্যরকম ছিল।বাড়ান্দার সামনে একটা জারুল ফুলের গাছ ছিল।বৈশাখ শুরু হতে না হতেই গাছ ভর্তি বেগুনী ফুলে ছেয়ে যেত।কিছু ফুল রেলিং এর ভেতর দিয়ে বাড়ান্দায় চলে আসত।বাড়ান্দার একপাশ বেগুনী হয়ে থাকত।গত বছর সেই গাছটাও কেটে ফেলা হয়েছে।এখন সেখানে তিনতলা একটা দালান হয়েছে।দালানের ঠিক পেছনের অংশ বাড়ান্দার সাথে লাগানো।বাড়ান্দায় দাড়ালেই মনে হয় যেন উঁচু প্রাচীরের একটা জেলখানা।মৌ এর মনের অবস্থার সাথে সাথে পরিবেশেও পরিবর্তন হচ্ছে।তার মানে কি প্রকৃতির সাথেও এমন কিছু ঘটেছে যার কারণে সেও পরিবর্তন হতে বাধ্য হচ্ছে।সেও ভেতরে ভেতরে কুকরে মরছে দিনদিন।প্রকৃতিও কি এখন সবকিছুতে স্বার্থ খোঁজে।ঐযে রেলিঙ এর ধার ঘেঁষে যে পাখিগুলো উড়ে যাচ্ছে তাদের ভেতরেও কি দুর্বোধ্য স্বার্থ বিদ্যমান?বিকেলের সুন্দর সূর্যাস্ত যে মেঘে ঢেকে দিল তার মধ্যে কিসের এমন স্বার্থ?প্রকৃতি তো নিজের নিয়মে চলে না।তাকে একজন মহান নিয়ত্রক নিয়ত্রণ করে যাচ্ছে অবিরত।তার মধ্যেও কি নিগূড় স্বার্থ রয়েছে?স্বার্থের বাইরে কি এই মহাবিশ্বে কিছুই হয় না?
মৌ এর মনের এমন উদ্ভট প্রশ্ন আর কেউ জানে না।তার সবচেয়ে কাছের ঐ ময়না পাখিটাও না।নিজের মধ্যেই প্রশ্ন গুলো আবর্তিত হয়ে একসময় অদ্ভুত তিক্ততায় সে বাড়ান্দা থেকে ঘরে ফেরে।ততক্ষণে মেঘে ঢাকা সূর্যও অস্ত হয়ে যায় নিভৃতে।মেঘ তবু সরে না।বিকেলের হলুদ রাঙ্গা মেঘ এখন সন্ধ্যার অন্ধকার মেখে রাতের পথে যাত্রা করে।ময়না পাখিটাও আর ছটফট করে না।অন্ধকারের সাথে মিশে সেও যেন এক অসার জড় বস্তুতে রুপান্তরিত হয়।

 ০৫/০২/২০১৫, বগুড়া

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন