শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

ফুল ও যুবক

পৌষের রাত্রি। শীত যেমন থাকার কথা ছিল এবছর তেমন নেই। গোলগলা একটা গেঞ্জির ওপর একটা ফুলশার্ট পরলে আর শীত লাগে না।বরঞ্চ একটু হাঁটাহাঁটি করলে গরম লেগে যায়।তখন শার্টের বোতামগুলো খুলে দিলে একটু স্বস্তি মেলে সাথে একটা ভাবও চলে আসে।উরাধুরা ভাব।হাতে একটা জলন্ত সিগারেট থাকলে খুব যায় ভাবখানার সাথে। কিন্তু সিগারেটের বদলে হাতে আছে দুইটা রজনীগন্ধা আর একটা লাল টকটকে গোলাপ। শীতকালে রুমের দরজা জানালা লাগানো থাকে। একটা বোতলে রজনীগন্ধা রাখলে তিন চার দিন রুম গন্ধে ম ম করবে। ফুলের দোকানে হরেকরকম ফুল।সবচেয়ে সস্তা কিন্তু গন্ধে সবচেয়ে দামী যে ফুল তা হল রজনীগন্ধা।বিভিন্ন সংবর্ধনায় হয়ত এইজন্যই ফুলটি জনপ্রিয়। সংবর্ধনার মাধ্যমেই ফুলটির সাথে পরিচয়। গোলাপখানা কেনার কোন উদ্দ্যেশ্য নাই।নিছক ভাল লাগা থেকে কেনা।দুইটা রজনীগন্ধা কেমন খাপছাড়া লেগেছিল তাই একটা লাল টকটকে গোলাপ সাথে টেপ দিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।দাম পনের টাকা। আগে কখনও কেনা হয়নি। ফুলের জন্য ভাললাগা কখনই ছিল না। প্রতিদিন ফুলের দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া হয় কখনও কেনা হয় না।আজ অনেকটা ইচ্ছাতেই অনেকটা ভাললাগা থেকেই ফুল কেনা।ফুলটা হাতে নিয়ে নাকে ধরতেই মগজ পর্যন্ত চাঙ্গা হয়ে উঠল মাতাল করা গন্ধে।সাথে সাথে উড়াধুড়া একজন যুবকের প্রেমিক হয়ে যেতে ইচ্ছা করল।ফুল প্রেমিক।প্রতিদিন দুইটা করে ফুল কিনবে সে এই সংকল্প করল।ফুল নিয়ে বুকের বোতাম খুলে হাটতে হাটতে বারবার ফুলগুলো নাকে ধরছিল আর ফুলের সুবাসে আত্নহারা হয়ে যাচ্ছিল যুবক।গন্ধটা মাথায় কেমন একটা নেশা লাগিয়ে দেয়।ফুল রাখার জন্য একটা টব কেনা দরকার।ফুল কেনার জন্য যতটুকু আগ্রহ থাকার দরকার ছিল টব কেনার জন্য তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখা গেল না।ফুলের দোকানের সাথেই কায়দা করে টবের দোকানগুলো।মানুষ যাতে হাতের নাগালেই কম দরকারী জিনিস পেয়ে যায় অথবা ফুল কেনা হলে টব কিনতে ভুলে না যায়।সব ব্যবসার কারসাজি।টবের দোকানে ঘুরেফিরে একটাও পছন্দ হল না।যেটা একটু পছন্দ হওয়ার মত তার দাম অতিরিক্ত।অসময়ে আলগা বিলাসিতার কোন প্রশ্রয় নেই।ফুল হাতে অহেতুক হাঁটতেই ভাল লাগছে।হাঁটতে হাঁটতে কখন যে নদীর পারে চলে এসেছে খেয়ালই নেই।এই সময়টা নদীর পার ফাকা থাকে।শীতল বাতাস বয়।কাপর চোপর ঠিকঠাক মত পরলেও কাপুনি ধরে হারে।সন্ধ্যার পরপরই তাই এখানে কেউ থাকে না।তবে এই কাপুনি ধরা বাতাসটাই যুবকটার খুব পছন্দের।বাতাসে শার্ট উড়ছে পতপত করে।প্রথমে গায়ে কাপুনি ধরে তারপর থুতনি।ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে নদীর ওপারে দৃষ্টি যায়।কুয়াশা নেই।আকাশে আধখানা একটি চাঁদ।নদীর পানির সাথে খেলা করানো আলো তার নেই।কুয়াশা না থাকার কারণে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়।আবছা আলোই একটা কুকুর আর তাকে ঘিরে আরো কয়েকটা ছাড়া জনশুন্য এই নদীর পার অনেকটা ভূতুরে হয়ে আছে।অথচ একটু আগেই এখানে কত লোকের সমাগম ছিল।কিছু দিন আগে এখানে একটা মেয়ে বসে ছিল।চুল তার খোলা ছিল।বাতাসে চুলগুলো যুবকের গাল ছুঁয়ে যাচ্ছিল।মেয়েটির গায়ের গন্ধ বাতাসে মিশে এক অলৌকিক শোভা ছড়াচ্ছিল।আজ হাতের ফুলগুলো সেই অভাব পুরণ করছে।ফুল আর নারী আলাদা কিছু নয়।তারও কিছুদিন পর এখানে সেই নারীই বসে ছিল।তখন তার গা দিয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল অথবা তার গায়ের গন্ধ যুবকের কাছে দুর্গন্ধের মত মনে হচ্ছিল।চারপাশের বাতাস জমাট বেঁধে এক গুমোট পরিবেশ তৈরি করেছিল।সেদিন যুবক এখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল।সেই দম বন্ধ করা বাতাসে তার বমি বমি লাগছিল।তারপর থেকে আর নদীর পারে আসা হয়নি।আজ ইচ্ছা করে সে আসেনি।অবচেতন মন অথবা দীর্ঘদিনের অভ্যস্থ পথই তাকে নিয়ে এসেছে।এসে খারাপ হয়নি।সেদিনের সেই গুমোট বাতাস আজ নেই।আজকের এই বাতাস অনেক পরিচিত।দূর দিগন্ত থেকে মহকাল ছাপিয়ে এই বাতাস এসে গায়ে লাগছে।ঠকঠকে কাপুনিতে একটা শিহরণ আছে।থুতনির কাপুনি আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে।একসময় মনে হয় দাঁত ভেঙ্গে যাবে।দূর থেকে একটা বাদুর পাখার আওয়াজ তুলে একটা তেতুল গাছে ঝুলে থাকে।কুকুর অহেতুক একবার ঘেউ করে থেমে যায়।চাঁদ কখন এপাশ থেকে ওপাশে চলে গেছে খেয়ালই করেনি যুবক।রাত গভীর হয়ে গেছে।গায়ের কাঁপুনি এবার থুতনি থেকে মাথায় চলে আসে।মাথার মগজ জমাট বেঁধে যায়।যুবক হাসতে থাকে।একসময় হাসির আওয়াজ গম্ভীর হয়ে ওঠে।নদীর ওপারে কোন দেয়াল নেই তবুও তার হাসির প্রতিধ্বনি যেন মহাকালের বুকে আছরে পরে আবার তার কানেই আলোড়ণ তৈরি করে।একটা পৈশাচিক সত্বা যুবককে ভর করে।যুবক হাতের ফুলগুলো একবার নাকে ধরেই যতজোরে সম্ভব মাটিতে আছাড় মারে।গোলাপের কয়েকটা পাপড়ি এদিক ওদিক ছড়িয়ে যায়।রজনীগন্ধাদুটো পুরোটাই থেতলে কুটিকুটি হয়।যুবক তার চটি পরা পা দিয়ে বার কয়েক গায়ের জোরে আবার ফুলগুলো পিষ্ট করে।যুবকের হাসি থামেনা একটা সিগারেট ধরানোর সময় টুকু বাদে।হাসির আওয়াজ চকচকে অন্ধকারে ভয়াল হয়ে যায়।কুকুরগুলো নির্বাক তাকিয়ে থাকে।রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়।দূরে একটা নৌকা থেকে টিমটিমে আলো যুবকের দিকে আসতে থাকে।ফুল পিষ্ট করার ফলে ধুলার সাথে মিশে একটা দুর্গন্ধ তৈরি করেছে।গন্ধটা তার অপরিচিত নয়।সে আর থাকতে পারে না।সেদিনের মত আজো যুবককে এখান থেকে পালিয়ে যেতে হয়।

২০/১২/২০১৬, রাজশাহী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন