শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

সূর্যাস্তে একদিন


একটা মানুষ জীবনে কতগুলো সূর্যাস্ত পায়?যতগুলো দিন সে পৃথিবীতে অতিবাহিত করে?না মানুষ প্রতিদিন সূর্যাস্ত পায় না।নিত্য নৈমত্যিক ঘটে যাওয়া অনেক জিনিসই আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না।কোন এক বিস্তৃত স্থির সময়ে নিত্য ঘটে যাওয়া জিনিস গুলো অন্যভাবে আমাদের চোখে ধরা পরে।সব সূর্যাস্ত সমান আভা বিস্তার করে না সবসময়।সমান ভাবে হলুদাভ আলোই রাঙ্গায় না চারপাশ।আলোরিত করে না অতীত কে।আজ ফাল্গুনের এক বিস্তৃত সূর্যাস্তে হয়ত অনেকেই বদ্ধ ঘরে টিভি সেটের সামনে নিজের প্রিয় প্রোগ্রাম দেখতে মশগুল।কেউ ঘুমে কাটায় অথবা সূর্যাস্তের দিকে ভ্রুক্ষেপ ও করে না।আজকের সূর্যাস্ত কিন্তু আমার কাছে আলাদা।সারাদিন ক্লাস আর টিউশনিতে দৌড়াদৌড়ির পর ক্লান্ত পায়ে সাইকেল ঠেলে যখন বাসায় ফিরছি,বাড়ির কাছের একটা সাকোতে উঠে নিজেকে জিড়িয়ে নেবার জন্য যখন একটু  সাইকেল থামিয়ে পশ্চিম আকাশে তাকাই,একি,ছোট একটা নদীর সীমানায় বিশাল আকাশ আজ অন্যভাবে সেজেছে যেন।সূর্যমামা তার নিজের লাল আভা ছিটিয়ে দিচ্ছে সারা আকাশ ময়।লোহিত সাগর আজ অস্ত আকাশে উঠে এসেছে।আর সেই সাগরের লাল পানির সুচারু ধারা যেন এই ছোট নদী বেয়ে সাকোর নিচ দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে দূরে। সাথে আমিও দৃষ্টি হারিয়ে চলেছি সূর্যের ওপাশে।একদৃশটিতে তাকিয়ে থাকতে চোখে নেশা ধরে গেল।নিজেকে হারিয়ে ফেললাম আকাশের কিনারে।কোন কিছু ভাবতে আর ভাল লাগছে না।সারাদিনের ক্লান্তি কোথায় হারিয়ে গেল।সারা আকাশ যেন আমার আজ।আমার জীবনকে তুলে ধরেছে বিশ্বের কাছে।আমার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি আমার কৃত সমস্ত কাজ।আমার অতীত।আমার বিরহ।আমার আনন্দ।সেই আকাশ ময় কিছু পাখির ঝাঁক উড়ে উড়ে যেন পাতা উল্টিয়ে দিচ্ছে আমার  জীবন ডায়েরীর।আমি পড়ে চলেছি।আমার জীবনকে আমি পড়ছি।ঠোটের ফাঁকে কখনো জমছে হাসি আবার কোন এক পাগলামীর ক্ষুদ্র মুহুর্তে চোখের কিনারে জমা হচ্ছে জলবিন্দু।গড়িয়ে পরবার আগেই অন্য এক রঙ চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে যায়।চোখে পলক পরে।দেখি,পড়ি, ফিরে যাই।বড় আপুর সাথে আমার সেই শৈশব,কথা তখনও ঠিক ফোটেনি।আপু আমার সাথে পৃথিবীর পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে।“বাবু ওইটা কি বলত”।আপুকে খুশি করার জন্য বলছি কিছু একটা।সেটা শুনেই আপু হেসে জড়িয়ে চুমু খাচ্ছে গালে। উৎসাহে বারবার বলছি।আপুর সাথে সারাদিন ছোটাছুটি।নতুন নতুন খেলা।বাল্যকালের সেই ছোটমঞ্চে আপু অভিনেত্রী আর আমিই তার প্রধান দর্শক।আমাকে খুশি করার জন্যও তার কত বিশেষ কাজ ছিল।আপু আমার থেকে বড় হলেও আমার উপযোগী করে খেলা বানিয়ে নিত।আমার সাথে কত মজা করে খেলত।পরে কতবার আপুর সেই অনর্থক কাজগুলোর জন্য করুনায় নাকি ভালবাসায় চোখ ভিজে উঠেছে।আপুকে আমি জীবনে কিছু দিতে পারলাম না এমন ভেবেও নিজেকে কতবার অপদার্থ মনে হয়েছে। তারপর আমার হারিয়ে যাওয়ার দিনটা চোখে পরল।আমার পৃথিবী অনেক ছোট।বাড়ি আর বাড়ির সামনে মাঠটা।আমি আর ইদ্রিস ঐ মাঠে প্রতিদিন ঘুড়ি উড়োতাম।সারাদিন টো টো করে মাঠময় ঘুরতাম।ইদ্রিস ঘুরির লাটাই ধরে থাকত।সেই কালো চেহারার ছোট মানুষ ইদ্রিস।কখনই তাকে নিজের কোমরের সাথে মানানসই প্যান্ট পড়তে দেখলাম না।কতবার আমার সামনে তার প্যান্ট খুলে পরল।সবসময় তার এক হাত বন্ধ থাকত প্যান্ট ধরে থাকার কাজে।বৈশাখের কোন এক কাল বৈশাখী ঝরে আমাদের ঘড়ির সুতো ছিড়ে গেল।ইদ্রিসের সেই গলা ফাটানো চিৎকার”সুতা ছিড়ছে রে”।ঘুড়ির পেছন পেছন দৌড়।দৌড়াতে দৌড়াতে আমার পৃথিবীর বাইরে চলে গেলাম।হারিয়ে গেলাম আমি বিশাল পৃথিবীতে।তারপর?তারপর আর একটু বড় হয়েছি।বড় হলে কি হবে মায়ের আচল  ছাড়া অসহায় আমি।বর্ষার একরাতে প্রচন্ড জ্বর উঠল গায়ে।প্রলাপ বকছি।মাথার পাশে মা বসে একটানা পানি ঢালছে।পানি ঢালছে কিন্তু জ্বর নামছে না।তখন মার অবস্থা দেখে কে?কত রাত যে আমার মাথার পাশে বসে মার নির্ঘুম রাত পার হয়েছে তার হিসাব কে রাখবে।মা রা কি এমনই হয়?আহা মা আমার মা।এই পাতাটা মায়ের সেই উষ্ণ আচলের মত কোমল।রংচটা শাড়ির আচলের মত মলিন।বাবার কথা মনে পরে।স্মরণ করার মত কোন ঘটনা না।এতদিন তাই মনেও আসে নি।আজ হটাৎ লাল আকাশের কিনারে বাবার হাসিমাখা খোঁচাদাড়িময় মুখখানা নতুন করে বাবাকে চেনায়।বাবারা এমন কাজ প্রতিনিয়ত করে আমার বাবাও করেছিল।আমাকে মেলায় নিয়ে গিয়েছিল।গোপিনাথপুরের মেলা।সারারাত বাবার সাথে যাত্রা দেখার পর আমি আর হাঁটতে পারছিলাম না।এতবড় ছেলেকে পিঠে করে বাবা কতটা পথ যে হেঁটেছিল আজ সেটা হটাৎ মনে পরল।এতদিন স্বাভাবিক ভাবেই মনের কোন এক কোনায় হারিয়ে গিয়েছিল।আশ্চর্য অস্ত আকাশ এত কিছু জানল কিভাবে?বাবার সেই পিঠ আমাকে যেন এখনও বহন করে চলেছে। মনটা হটাৎ কেমন করে উঠল।চোখ ভরে পানি চলে আসল।চোখ ঝাপ্সা হল।ঝাপ্সা চোখে আরো ভালভাবে দেখতে পাচ্ছি সবকিছু।বাবা তোমাকে ভালবাসি আমি।কখনই বলা হয় নি।হবেও না জানি।তারপর হটাৎ করে দাদি একদিন মারা গেলেন।আমার এখনো মনে হয় না দাদি নেই।দাদির সাথে আমার শৈশবের অনেকটা রঙ্গিন মুহুর্ত কেটেছে।দাদি আমার  প্রথম প্রেমিকা।শৈশবেই যিনি আমাকে প্রেমিক বানিয়েছিলেন তার কতটা সাহচর্যে থাকতে হয়েছিল কত আবেগ তার সাথে ভাগাভাগি করতে হয়েছিল,কত অভিমান,কত কাহিনী রাতের পর রাত,দিনের পর দিন আমাকে মাতিয়ে রেখেছিল তার দায়ভার এই অস্ত আকাশ কখনই নিতে পারবে না।তবে এত বড় আবেগ সে কেন ধারণ করতে গেল।দাদি তো শুধু আমার অতীত না।দাদি আমার সব।কোন কোন বিশেষ কাজ ছিল যেগুলো আমি শুধু দাদির ভাললাগার জন্যই করতাম।আমি ইচ্ছা করেই পেটে ব্যথার ভান করে  দাদির কোলে শুয়ে থাকতাম।আজ দাদি আমার সমস্ত কাজে থাকে।তার সাথে এখনও আমার মান অভিমান হয়।ঘুমের ঘোরে তার সাথে কথা বলি।এখনও মনে হয় বাবা মার সাথে রাগ করে দাদির সাথে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছি।আমি আর অস্ত আকাশে তাকিয়ে থাকতে পারছি না।এই আকাশ আমার খুটিনাটি সব উদ্ধার করে ফেলল।আমি এখান থেকে বেরিয়েও আসতে পারছি না।আমার দৃষ্টি হারিয়ে গেছে আমার আকাশে।আপুর বিয়ের দিন।এই তো কয়েকদিন আগের কথা।আমাদের বাড়ি সাজানো হয়েছিলো রংবেরঙ্গের বাতি দিয়ে।আজ অস্ত আকাশ যেন আমার বোনের সেই বিয়ের আলোকসজ্জায় ধারণ করে আছে।কত ধুম ধাম।আমাদের বাড়ি আত্নীয়সজন দিয়ে ভরে গেল।আমি তাদের অনেককেই চিনিনা।অনেকেই আমাকে দেখেও চিনতে পারে না।আমার মা গর্বের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়।
“আমার ছেলে।ক্লাস সেভেনে পরে।রোল দুই।আকবরের রোল এক,আমার ছেলের থেকে বয়সে কত বড়”
সেই বয়সে কত সুনাম কুরিয়েছি আত্নীয়দের কাছ থেকে।অনেকেই বলে “কত ছোট দেখেছি।এই কয়দিনেই কত বড় হয়েছে ইশিতার ছেলে”।বড় হওয়া যেন একটা বিশাল কাজ তখন আমার এমন ভঙ্গি।এমন কাচুমাচু হয়ে থাকতাম যেন আমার মত ভদ্র ছেলে আর নাই।দাদি গোছের যারা তারা তো কোন কথা বলার আগেই বলত “ছেলের তো বউ দেয়া দরকার”।এই কথা শোনার পর আমার লজ্জায় মুখ লাল হয়ে যেত।আরেকজন প্রতিবাদ করত “এক চোকরার কয়টা বউ লাগবে।আমি তো আছিই”।আরো কত কথা।বড় আপুর বিয়ে হয়ে গেল।হ্যা আমার শৈশবের সেই খেলার সাথীর বিয়ে হল।আপুর বিদায়ের সময় সবাই কান্নাকাটিতে সারা বাড়ি তোলপাড় শুরু করে দিল।শুধু আমার চোখে কোন পানি নেই।আপু একে একে সবার থেকে বিদায় নিচ্ছে।সবশেষে এল আমার পালা।আপু আমাকে জরিয়ে ধরতেই আমার চোখ ভেসে কোথা থেকে পানি চলে আসল।তখন মনে হচ্ছিল এইত আমাকে ছেড়ে আপু এখন চলে যাবে।আর কখনও আমরা খেলতে পারব না।আমার সেই জীবনের প্রথম খেলার সাথী আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে।আপু তখন কানের কাছে আস্তে করে বলল “যাবি বাবু আমার সাথে?”  আমি ততদিনে বুঝে গেছি চাইলেও আমি আপুর সাথে যাইতে পারব না।আপু চাইলেও আমাকে নিয়ে যেতে পারবে না।সব বিদায়ের চিত্র দেখতে দেখতে সূর্যেরও বিদায় হয়ে গেল।আকাশের লালিমা আস্তে আস্তে হালকা হতে থাকল।সূর্য অস্ত গেলেও তার আভা আরো এক অবশিষ্ঠ জীবনের কথা মনে করিয়ে দেয়।সূর্যের অনুপস্থিতিতে তার যে হলুদাভ আভা সারা আকাশময় বিরাজ থাকে।আমাদের জীবনেও সূর্যের মত কারো আবির্ভাব হয়।তার উজ্জ্বল আলোয় আমাদের জীবনও প্লাবিত হতে থাকে।সেই সূর্য অস্তমিত হওয়ার সাথে সাথে তার আভাও আমাদের জীবনময় বিরাজ করে।সেই আভা বহন করতে করতে আমাদের জীবনও অস্তমিত সূর্যের মত শেষ হয়ে আসে।দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় নিজের কথা মনে হয়।চারপাশে অন্ধকার হয়ে আসছে।বাসায় ফিরতে হবে।শেষ পাতা এখনও পড়া হয় নি।আলো কমিয়ে আসছে।শেষ পাতাটা ঝাপ্সা হয়ে আসছে।মেয়েটা আমার সাথে কেন এমন করল।আমার তো কোন দোষ ছিল না।সূর্যের আলো যেভাবে ধারণ করতে হয় আমিও সেভাবেই ধারণ করেছি। আমি তো তার বিন্দু মাত্র ত্রুটি করি নাই।আমিও তাকে ভালবেসেছি।কোন খাদ ছিল না।সেই গভীর চোখ,হাওয়ায় উড়ন্ত চুল,তার ক্ষুদ্র কথাবার্তা আমার জীবনকে মুহুর্তেই আলোকিত করে তুলেছিল।আমি তো তার প্রেমে পরেছিলাম।আমার আকাশজুড়ে তার মুক্ত বিচরণ ছিল।ঐ সূর্যের মতই।আমিও আকাশ পেতে তার আলোর পানে চেয়ে থেকেছি।কোন মেঘের আবির্ভাব সহ্য করিনি।সহজ কথায়,সহজ চলনে আমি হারিয়ে যেতাম।আমার জীবনটাকে পরিবর্তন করেছিল আমার সেই সূর্য।আমি বাঁচতে শিখেছি,জীবনের মানে শিখেছি তার কাছে।অথচ সেই আমার সমস্ত জীবনের অর্থ পাল্টে দিল।সে অস্ত গিয়ে আমার আকাশ কে গাঢ়ো হলুদাভ আভায় ভাসিয়ে দিল।তার অনুপস্থিতেও এই হলুদাভ রেখা আমার আকাশ ময় বিরাজ করে।আমার পূর্ব পশ্চিমময় এক সুদীর্ঘ রেখা টেনে আমাকে আবদ্ধ করে রাখে।আমি এখন হাসতে পারি না।আমি এর কোন মানে পাই না।হয়ত ব্যর্থতা।অথবা অন্যকিছু।এক নিগূঢ় অপমানে আমি ভেতরে মুষরে পরি।
চারপাশে এখন ঘোর অন্ধকার।আমি সাইকেল এ আমার দৃঢ় পায়ে ঠেস দিয়ে চলেছি।একটু আগের সেই সূর্যাস্তের কোন চিহ্ন নেই চারপাশে।কেউ জানবেনা আজকের এই সূর্যাস্ত আমার জীবনকে কতটা নাড়া দিয়েছে।একসাথে সমগ্র জীবন ডায়েরী কোন সূর্যাস্ত তুলে ধরেনি আগে।আমি আমার সমগ্র জীবনকে এখনও দেখতে পাচ্ছি যেন।অন্ধকারের ভেতর আমার সাইকেল এক ঘোরে অগ্রসর হচ্ছে সাথে আমিও।আমার এই ঘোর কাটতে আগামীকালের নতুন সূর্যের খুব প্রয়োজন।

০৬।০৩।১৪, রাজশাহী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন