চৈত্র মাসে যে নদীতে
হাটু পানি থাকে শ্রাবনের অঝোর ধারা সেই নদীকে কানায় কানায় ভরে তুলেছে।রোগা লিকলিকে
কোন দানব কে উপযুক্ত যত্ন নিয়ে কে যেন আবার তাকে হিংস্র বানিয়েছে।মাঝ নদীতে এখানে
সেখানে পাক দেখা যাচ্ছে।চাঁদের আলো সেই পাকে পরে গ্যালাক্সির মত অসংখ্য নক্ষত্রের
মত ঘুরপাক খাচ্ছে।যেই ঘাটে আগে গরু বাছুর চরে বেড়াত সেই খানে এখন দাঁড়ানো যায় না।পানি হুঙ্কার দিয়ে আছড়ে পরে ।একটা
ডিঙ্গি নৌকা সেই আছড়ে পরা পানির সাথে পাল্লা দিয়ে একবার ডানে একবার বামে কাঁত
হয়ে অপরিসীম মনোবল নিয়ে ভেসে আছে।তার গলুই
টা একটা রশি দিয়ে খুটির সাথে বাঁধা।ছোট্ট একটি খুটি কিন্তু খুব শক্ত করে পোঁতা আছে
ঘাটের শক্ত মাটিতে।হালের উশৃংখল ষারের নাকে নাকল পড়িয়ে খুটির সাথে বাধলে যেরকম
দাপাদাপি করে কিন্তু খুটি ছিঁড়ে পালাতে পাড়ে না নৌকার অবস্থাও ঠিক একই রকম।চাঁদের
আলোই ওপাশের চরের যে মাথা দেখা যাচ্ছে তা নদীর বুকে কচুরিপানার ঝাঁকের মতই মনে
হয়।ঘাটে সন্ধার পরে কয়েকটি ব্যাং আর ঝিঝি
পোকা ছাড়া কোন প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া দুস্কর।সন্ধ্যা হয়েছে একটু
আগে।অন্যদিন হলে এখন আলো থাকত।মাগরিবের নামাজের ওয়াক্ত এখনও আছে।অর্থাৎ, পশ্চিম আকাশে লালীমা এখনও থাকার কথা কিন্তু
আকাশ মেঘলা থাকার কারণে অন্যদিনের থেকে আজ অনেক অন্ধকার।মেঘের ফাঁকে ফাঁকে যতটুকু
চাঁদের আলো এসে নদীতে পরছে তা অসংখ্য ঢেউ ভাগাভাগি করে গায়ে মাখছে।আলোর সাথে ঢেউএর
এই খেলা শাহেদ আজ ঘাটে না থাকলে একমাত্র বিধাতা ছাড়া এই অপরূপ সৌন্দর্য দেখার কোন দর্শক উপস্থিত থাকত না।মৃদু মন্দ বাতাস থাকার কারণে
একটা সিগারেট ধরানোর জন্য বেশ কয়েকটা কাঠি খরচ করতে হল।অবশেষে কোনমতে আগুনটা ধরতেই
কয়েকটা পরপর টান দিয়ে এক লাফে ডিঙ্গি নৌকার ওপর বসে পরল শাহেদ।নৌকার দুলুনির সাথে
সাথে চব্বিশ বছরের পুষ্ঠ দেহখানাও দুলতে
থাকে।নৌকার দুলুনি একটু ভাড় পেয়ে কিছুটা হলেও কমেছে।শাহেদ সেদিকে খেয়াল না করে
বুকের বোতাম কখানা খুলে দেয়।সাথে সাথে নৌকার পালের মত পতপত করে উড়তে থাকে সবুজ
রঙের পুরনো শার্টটি।কদিন আর হবে,দশ বছর
আগেও এখানে একলা আসতে বড্ড ভয় পেত সন্ধার পরে।কত গা ছমছম করা গল্প আছে এই ঘাটকে ঘিঁরে।আজ সেগুলো কিছুই মনে আসছে
না।ছোটবেলার সেই ভয়ের বিন্দুমাত্র যদি এখন থাকত তাহলে ঘাট পর্যন্ত অন্তত আসা যেত
।এমন উথাল পাথাল নদীর বুকে একটি ডিঙ্গি নৌকায় একা বসে থেকে সিগারেট ফুকা যেত
না।বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের ভয়ের
পরিসর অন্যরকম হয়ে যায়।তার বড় পৃথিবীতে ভয় পাওয়ার বিষয়বস্তুর আকারও বড় হতে থাকে।ডিঙ্গির এই দড়িটা খুলে দিলে কি সে ভয় পাবে?না
সে নিস্তার পাবে।নৌকা দুলতে দুলতে তাকে নিয়ে যাবে দূরে কোথাও।অজানা এক দেশে।যেখানে
তাকে কেউ চেনে না।তার নাম জানে না।অথবা কোন এক পাকে পাক খেতে খেতে নদীর অতল গহবরে
হারিয়ে যাবে।চৈত্র মাসে যেখানে সে ফুটবল খেলে সেই বিরান বালুর তলে সে ডুবে
থাকবে।তার বিন্দু মাত্র ভয় করে না।দশ বছরে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে।অনেক ভাল
লাগা খারাপ লাগায় পরিণত হয়েছে ।অনেক কাছের
মানুষ দূরে চলে গেছে আবার অনেক অজানা মানুষ জীবনের অনেক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।চব্বিশ বছর এই নদী, এই চন্দ্র, এই আবেগগুলোর সাথে শাহেদ অভ্যস্ত হয়ে
উঠেছে।জীবন খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে।আগে যেসব নিয়ে কোন চিন্তা ছিল না সেসব এখন চিন্তার প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে।এমন
নিস্তব্ধ পরিবেশে আসলে যেই চিন্তাগুলো মাথার মধ্যে আসবেই তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে
অতীতের সম্পর্ক গুলো। নৌকা যেমন একটা রশি
দিয়ে শক্ত খুটির সাথে বাঁধা সেইরকম এক শক্ত বন্ধনে তার জীবনটাও বাঁধা পরে
আছে।শাহেদ চাইলেই এই নৌকার বাধন খুলে
হারিয়ে যেতে পারে কিন্তু তার সেই জীবনের রশিটা সে ছিন্ন করতে পারে না।চব্বিশ বছরে সেই রশিটা অনেকটা শক্ত
হয়ে অজানা এক যায়গায় খুটি গেঁড়েছে।সেই খুটি বা দড়ি ছিন্ন করার ক্ষমতা বা সাহস তার নেই।হ্যা ভয়টা এখানেই।যে জীবন
মানুষের সেই জীবন এই নৌকা বা অন্য কোন সৃষ্টির থেকে আলাদা।নৌকার খুটি ইচ্ছা করলেই
তোলা যায়।প্রতিদিন সকাল বেলা মাঝি সেই খুটি তোলে আবার সন্ধ্যায় পোতে কিন্তু জীবনের
সাথে যে রশি পোতা আছে তার সাথে আরো জীবন বাঁধা।সেই জীবন ছিন্ন করার ভয় শাহেদ কে
পেয়ে বসে।এক অজানা রশি অথচ কোন ভাবেই
সেটাকে ছিন্ন করা সম্ভব নয়।শাহেদ ভয়ে মূর্ছা যায়।চারপাশের নিস্তব্ধতা আরো গাঢ় হয়ে
ওঠে।দূর থেকে খুটির গোড়ায় কে যেন নাড়া দেয়।সিগারেট টা ততক্ষণে শেষ হয়ে
এসেছে।যেভাবে লাফ দিয়ে নৌকায় উঠেছিল শাহেদ ঠিক সেইভাবে একটা লাফ দিয়ে নৌকা থেকে ঘাটে নামে।শাহেদের পশ্চাৎমুখী
বেগ নৌকাটাকে একটু দূরে ঠেলে দেয়।নৌকা আগের মত দুলতে থাকে ঢেউএর সাথে খাপছাড়া
ভাবে।
২৬।০৭।১৬, রাজশাহী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন