ছাঁদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি।আশ্বিনের আকাশ বলে একটু ঘোলাটে, ছোট ছোট মেঘ উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে এপার থেকে ওপার।মেঘের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগে মাঝে মাঝে।কখন এপার থেকে ওপারে চোখ ঘুরে যায় বোঝা যায় না।তবে আজ দৃষ্টি আটকে গেল আকাশে একলা একটা নীল রঙের ঘুড়ির মধ্যে।কে কোথা থেকে উড়াচ্ছে তার কোন খোঁজ নেই।শুধু ঘুড়িটা একলা উড়ে যাচ্ছে মেঘ ঘেঁষে ঘেঁষে।যেন কোন অভিলাষী মন মেঘের সাথে সম্পর্ক গরবার পায়তারা করছে।এমন একটা আশ্বিনের বিকেলে ইদ্রিস এর সাথে আমার পরিচয় ঘটে।
তখন আমার বয়স সাত বছর।বাবা ছিলেন সরকারী বিদ্যুৎ বিভাগের অডিট। তার দরুন প্রায় প্রতি বছর বাবার ট্রান্সফারের নোটিস আসত।ট্রান্সফার আমাদের কাছে খুব পরিচিত একটা শব্দ।তার মানে আবার এখান থেকে অন্য কোথাও আমাদের উদ্বাস্তুর মত স্থানান্তর হতে হবে,আমার বালক মন এটাই জানত।তবে যেদিন ট্রান্সফারের নোটিস বাবা পেত সেদিন অনেক মন খারাপ করে বাসায় ফিরত।বাবার মুখ দেখেই বুঝতে পারতাম আজ ট্রান্সফারের নোটিস হয়েছে।আমি মনে মনে আনন্দ পেতাম নতুন জায়গা নতুন বন্ধু নতুন স্কুল।সাথে সাথে পুরোনো সব সম্পর্ক ছিন্ন করার মানসিক প্রস্তুতি নিতাম।অনেক দিন নাটোরে থাকার পর বাবার ট্রান্সফার হল মৈমনসিং এ।তল্পিতল্পা সব গুছিয়ে নিয়ে একটা ভোরে আমি বাবা আর মা রওনা হলাম নতুন এক জায়গায়।আমি বরাবর যেমনটা কল্পনা করতাম তার সাথে কিছুই মিলত না নতুন জায়গার।মৈমনসিং এর ক্ষেত্রেও তাই হল।খোলা একটা জায়গায় কোয়ার্টার।আসে পাশে বাড়ির সংখ্যা খুব কম।বাসাটা মনে হয় অনেক দিন ফাকা ছিল।রংচটা দোতলা খাকি রঙ এর একটা বাসা।প্রথমে আমার ভুতুরে বাড়ি বলেই মনে হল।তবে বাসাটা মা অনেক সুন্দর করে সাজালেন।অল্প সময়ে বাসা কিভাবে সাজাতে হয় মা সেটা খুব ভাল করেই জানেন।দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা।হয়ত স্থায়ী কোন বাসা আমাদের থাকলে মা এই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারতেন না।পরিবেশ মানুষ কে অভিযোজন শেখায়।তবে আমার ক্ষেত্রে পরিবেশ যেন এবার প্রতিকূল এ ছিল।আমার স্কুল এখান থেকে চার কিলোমিটার দূরে।বাবার জীপ এ করে স্কুল এ যাই আবার জিপ এ করে স্কুল থেকে আসি।সারাদিনে মা আর বাবা ছাড়া কারো সাথে কোন কথা হয় না।স্কুল এ ছেলেপেলেরা কেমন জানি গোমরা টাইপ।আমার সাথে কথা বলত না।আমি আমার মত থাকি।বাসায় এসে ড্রইং খাতা নিয়ে বসে পরি।সন্ধ্যায় মা গান শিখান।রাতে বাবা ফিরলে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পরি।এই ছিল আমার প্রতিদিনের রুটিন।এভাবে দুই তিন মাস কেটে গেল।আমার খারাপ লাগতে শুরু করল।আগে কোথাও বন্ধু বানাতে এত সময় লাগে নি।একই কোয়ার্টার এ অনেক পরিবার থাকতাম।আমার মত দুই একজনকে পেয়ে যেতাম খুব তারাতারি এমনকি যেদিন যাই ঐদিনই বন্ধু বানিয়ে ফেলি।কিন্তু এখানে আমাদের কোয়ার্টারে তো কেউ থাকেই না তার আশে পাশে কোন বাড়ি পর্যন্ত নেই।বিকেল বেলা ছাদে বসে বসে ড্রইং করি একা।একদিন ছাঁদে উঠে দেখি একটা ঘুড়ি রেলিং এর ওপর পরে আছে।বাতাস লেগে হাল্কা দুলছে।আমি যেন অমাবস্যার চাঁদ দেখার মত কিছু পেলাম।ছুটে গিয়ে ঘুড়িটা হাতে নিতেই নিচে তাকিয়ে দেখি লিকলিকে ধরনের আমার সমবয়সী একটা ছেলে চিৎকার দিয়ে বলছে “ওটা আমার ঘুড়ি, ওটা আমার ঘুড়ি”
দৌড়ে নিচে গিয়ে দরজা খুলে ওর সামনে দাঁড়াতেই অপরাধীর মত আমাকে বলল “ওটা আমার ঘুড়ি”
ছেলেটা উচ্চতায় আমার সমান কিন্তু চেহারায় অপুষ্টির কারণে আমার থেকে আরো বেশি বয়েসী মনে হচ্ছিল।ছেড়া হাফপ্যান্ট একহাতে ধরে আমার দিকে একহাত বাড়ায়ে ছিল।সে ধরেই নিয়েছিল আমি তাকে ঘুড়িটা দিব না।একটা বিনয়ী ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকায়ে ছিল ও।আমি ঘুড়িটা তার হাতে দিতেই
ভয় পাওয়া হরিণের মত দিল এক দৌড়।আমি তাকে পেছন থেকে ডেকেই যাচ্ছিলাম “এই শোন,এই শোন?”
তার পেছন দিকে তাকাবার কোন অবকাস নেই।নিমিষের মধ্যে উধাও হয়ে গেল ছেলেটা।আমি আগের মত ছাঁদে গিয়ে ড্রইং করতে বসলাম।মন থেকে কিছুতেই ছেলেটার দৌড় সরাতে পারছিলাম না।ও আমাকে দেখে এমন দৌড় দেওয়ার কারণ কী?ওর কথা চিন্তা করতে করতে এক প্রকার দিনটা কেটে গেল আমার।পরের দিন ছাঁদে দাঁড়িয়ে ওর দৌড়ের পথের দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ।ওকে এর পরের কয়দিনে আর পাওয়া গেল না।একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে রাস্তার ধারে দেখি একটা ছেলে কাঁধে বস্তা নিয়ে কাগজ কুড়াচ্ছে।আমার চিনতে বাকি রইল না এই সেই ছেলে যে আমার হাত থেকে ঘুড়ি নিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিল।আমি ড্রাইভার আঙ্কেলকে বলে জীপ থামিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।সে ততক্ষণে আমাকে চিনতে পেরেছে।আমাকে নামতে দেখে সে আবার তার ঝুলে পরা প্যান্টটা বাম হাতে চেপে ধরে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল।আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
তুমি সেদিন দৌড় দিলে কেন?
ছেলেটা কোন কথা বলল না।মাটির দিকে তাকিয়ে রইল।আমি এবার আস্তে তাকে বললাম
তুমি আমাকে একটা ঘুড়ি বানিয়ে দিবে?
ও মুখে কিছু বলল না তবে মাথা ডান দিকে অনেকটা হেলিয়ে সম্মতি জানাল।
কাল তুমি আসবে কিন্তু।আমি এখন চলে যাচ্ছি।
ও আবার একই ভাবে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল।আমি বাসায় চলে আসলাম।তখন আর আমার কিছু ভাল লাগছে না।কাল কখন হবে।কখন ঐ ছেলেটার থেকে ঘুড়ি বানিয়ে নেব।আচ্ছা ছেলেটার নাম কি?কাল আগে তার নাম জিজ্ঞেস করতে হবে।
পরেরদিন স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগ রেখে আগে ছাঁদে উঠলাম।দেখি কিছুটা দূরে ছেলেটা হাতে কঞ্চি আর একটা চাকু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ।আমি ডাকতেই আমার গেটের দিকে চলে আসল ও।ওকে ছাঁদে নিয়ে আসলাম।ওর মুখে কেন জানি আর আগের মত ভয়ের চিহ্ন নেই।আমার সাথে খুব সহজ ভাবে মিশছে।
তোমার নাম কি রাফি?
আশ্চর্য এই ছেলেটা আমার নাম জানে কিভাবে।
সেদিন ড্রাইভার তোমারে রাফি বলে ডাকছিল ওখান থেকে তোমার নাম জানি।আমার নাম ইদ্রিস।ঐ যে তালগাছটা দেখছো তার ওপারে রেললাইনের সাথে আমাদের বস্তি।একটু কাগজ আর আঠা দাও?
তুমি কাগজ কুড়াও কেন?স্কুল এ যাও না।
না।স্কুল এ যাইতে ভাল লাগে না।আর কাগজ কুড়াই প্যাটের দুঃখে।
“প্যাটের দুঃখে” সে এমন ভাবে বলছিল যেন সে এক দক্ষ কর্মজীবী বালক।পেট ছাড়া সে আর কিছু বোঝে না।
আমি তাকে কাগজ এনে দিতেই সে খুব সুন্দর ফ্রেম তৈরি করে ফেলল।চোখের এক কোনায় নিয়ে মাফজোখ ঠিক করে দেখল।তারপর একটু উড়িয়ে আমার হাতে দিয়ে বলল “দারুন হইছে রাফি ভাই।একদম চিলের লাহান উরবো খালি আকাশ বাও পাইলে”
“আকাশ বাও”মানে মাটির চেয়ে আকাশে অনেক বেশি বাতাস থাকে এটা আমি তার কাছ থেকে পরে শুনেছি।তার কাছ থেকে এমন আরো অনেক শব্দ শিখেছি যেগুলো আগে কখনও জানতাম না।“কাউয়ার কুলি”নামে একধরনের ছোট ফলের নাম শুনেছি যেটা বাঁশের খোলা চোঙ্গার দুই মাথায় দুইটা দিয়ে একপাশ থেকে চাপ দিলে বন্দুকের মত কাজ করে।
ঘুড়ি বানিয়ে আমরা উড়াতে গেলাম।অনেকক্ষণ ঘুড়ি উড়ালাম।ঘুড়ি আমি আগে কখনও উড়াইনি।এত মজা লাগত ইদ্রিস এর সাথে ঘুড়ি উড়াতে।ও তার পুর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ঘুড়ির অনেক আচরণ বিধি বলতে পারত।ঘুড়ি উড়তে উড়তে যেকোন একদিকে কাঁত হলে সুতা ঢিলা করতে হবে কারণ তখন “আকাশ বাও” বেশি।আবার ঘুড়ি কম উড়লে নামায়ে ঘুড়ির নাভিতে প্যাঁচ দিতে হবে।কম বাতাস হইলে লেজ ছোট রাখতে হবে।ঘুড়ির মতি বুঝে নামাইতে হবে।নাহলে সুতা ছিঁড়ে যেতে পারে।এভাবে ঘুড়ি উড়ানোর সব কৌশল আমি ইদ্রিস এর কাছ থেকে রপ্ত করে নিয়েছিলাম।ইদ্রিস প্রতিদিন আমাকে একটা করে ঘুড়ি বানিয়ে দিত আর সেটা নিয়ে আমরা সারা বিকেলভর উড়াতাম।একদিন আমাদের ঘুড়ি মেঘের কাছাকাছি চলে গেছে।দুজনের উত্তেজনার আর শেষ নেই।আরো সুতা ছাড়ি।মেঘ মাঝে মাঝে ঘুড়িটাকে ঢেকে দিচ্ছে।এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে।ঘুড়ি নামানোর নাম নেই।ইদ্রিস পাশে থাকলে যেন আমার সাহস অনেক বেড়ে যেত।এমন সময় ঘুড়ির সুতো গেল ছিড়ে।ইদ্রিস
“সুতা ছিড়ছে”বলে দিল এক দৌড়।আমি তার পিছে পিছে দৌড় দিলাম।ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে আমরা দুজনে ছুটছি আর ছুটছি।সেদিন কোথায় গিয়েছিলাম জানি না।আমি দৌড়াতে দৌড়াতে অজ্ঞান হয়ে পরেছিলাম।জ্ঞান ফিরে দেখি আমার মাথার কাছে মা বসে আছেন।এর পরের কয়েকদিন ইদ্রিস আর আসল না।তার বাসাও চিনি না।তার কোন খোঁজ আমার কাছে নেই।ইদ্রিস ছাড়া আমি যেন আরো অসুস্থ হয়ে পরছি।এর কয়েকদিন পরেই আবার বাবার ট্রান্সফারের নোটিস হল।তখন আমার অবস্থা দেখে কে?ইদ্রিস ছাড়া আমার যেন চলবেই না।আমি মাকে প্রতিরাতেই বলতাম “আচ্ছা মা বাবার ট্রান্সফার কেন হয়?ট্রান্সফার হলে শুধু আমাদের কয়জনের যেতে হবে কেন?আমাদের চারপাশের সবাই আমাদের সাথে কেন ট্রান্সফার হয় না?”
মা আমার প্রশ্নের যেসব উত্তর দিতেন তার কোনটারই আমি ভিত্তি খুঁজে পেতাম না।আমি কি খুব কঠিন প্রশ্ন করি।বারবার আমার এটাই মনে হত।ইদ্রিস এর সাথে আমার আর দেখা হয় নি।মাঝে মাঝে ইদ্রিস কে স্বপ্নে দেখতাম।“বাঁয়ে কাটান রাফি ভাই,ডানপাশে বাতাস বেশি”
আজ এই ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে আমার ইদ্রিস এর কথা খুব মনে পরছে।আমার মনে হচ্ছে ইদ্রিসও কোন এক জায়গা থেকে এই ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে।আমার সাথে তার চোখাচোখি হচ্ছে এই ঘুড়ির মাধ্যমে।
১৫/০৭/২০১২, রাজশাহী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন