শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

ট্রান্সফার


ছাঁদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছিআশ্বিনের আকাশ বলে একটু ঘোলাটে, ছোট ছোট মেঘ উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে এপার থেকে ওপারমেঘের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগে মাঝে মাঝেকখন এপার থেকে ওপারে চোখ ঘুরে যায় বোঝা যায় নাতবে আজ দৃষ্টি আটকে গেল আকাশে একলা একটা নীল রঙের ঘুড়ির মধ্যেকে কোথা থেকে উড়াচ্ছে তার কোন খোঁজ নেইশুধু ঘুড়িটা একলা উড়ে যাচ্ছে মেঘ ঘেঁষে ঘেঁষেযেন কোন অভিলাষী মন মেঘের সাথে সম্পর্ক গরবার পায়তারা করছেএমন একটা আশ্বিনের বিকেলে ইদ্রিস এর সাথে আমার পরিচয় ঘটে
তখন আমার বয়স সাত বছরবাবা ছিলেন সরকারী বিদ্যুৎ বিভাগের অডিট তার দরুন প্রায় প্রতি বছর বাবার ট্রান্সফারের নোটিস আসতট্রান্সফার আমাদের কাছে খুব পরিচিত একটা শব্দতার মানে আবার এখান থেকে অন্য কোথাও আমাদের উদ্বাস্তুর মত স্থানান্তর হতে হবে,আমার বালক মন এটাই জানততবে যেদিন ট্রান্সফারের নোটিস বাবা পেত সেদিন অনেক মন খারাপ করে বাসায় ফিরতবাবার মুখ দেখেই বুঝতে পারতাম আজ ট্রান্সফারের নোটিস হয়েছেআমি মনে মনে আনন্দ পেতাম নতুন জায়গা নতুন বন্ধু নতুন স্কুলসাথে সাথে পুরোনো সব সম্পর্ক ছিন্ন করার মানসিক প্রস্তুতি নিতামঅনেক দিন নাটোরে থাকার পর বাবার ট্রান্সফার হল মৈমনসিং তল্পিতল্পা সব গুছিয়ে নিয়ে একটা ভোরে আমি বাবা আর মা রওনা হলাম নতুন এক জায়গায়আমি বরাবর যেমনটা কল্পনা করতাম তার সাথে কিছুই মিলত না নতুন জায়গারমৈমনসিং এর ক্ষেত্রেও তাই হলখোলা একটা জায়গায় কোয়ার্টারআসে পাশে বাড়ির সংখ্যা খুব কমবাসাটা মনে হয় অনেক দিন ফাকা ছিলরংচটা দোতলা খাকি রঙ এর একটা বাসাপ্রথমে আমার ভুতুরে বাড়ি বলেই মনে হলতবে বাসাটা মা অনেক সুন্দর করে সাজালেনঅল্প সময়ে বাসা কিভাবে সাজাতে হয় মা সেটা খুব ভাল করেই জানেনদীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাহয়ত স্থায়ী কোন বাসা আমাদের থাকলে মা এই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারতেন নাপরিবেশ মানুষ কে অভিযোজন শেখায়তবে আমার ক্ষেত্রে পরিবেশ যেন এবার প্রতিকূল ছিলআমার স্কুল এখান থেকে চার কিলোমিটার দূরেবাবার জীপ করে স্কুল যাই আবার জিপ করে স্কুল থেকে আসিসারাদিনে মা আর বাবা ছাড়া কারো সাথে কোন কথা হয় নাস্কুল ছেলেপেলেরা কেমন জানি গোমরা টাইপআমার সাথে কথা বলত নাআমি আমার মত থাকিবাসায় এসে ড্রইং খাতা নিয়ে বসে পরিসন্ধ্যায় মা গান শিখানরাতে বাবা ফিরলে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে পরিএই ছিল আমার প্রতিদিনের রুটিনএভাবে দুই তিন মাস কেটে গেলআমার খারাপ লাগতে শুরু করলআগে কোথাও বন্ধু বানাতে এত সময় লাগে নিএকই কোয়ার্টার অনেক পরিবার থাকতামআমার মত দুই একজনকে পেয়ে যেতাম খুব তারাতারি এমনকি যেদিন যাই ঐদিনই বন্ধু বানিয়ে ফেলিকিন্তু এখানে আমাদের কোয়ার্টারে তো কেউ থাকেই না তার আশে পাশে কোন বাড়ি পর্যন্ত নেইবিকেল বেলা ছাদে বসে বসে ড্রইং করি একাএকদিন ছাঁদে উঠে দেখি একটা ঘুড়ি রেলিং এর ওপর পরে আছেবাতাস লেগে হাল্কা দুলছেআমি যেন অমাবস্যার চাঁদ দেখার মত কিছু পেলামছুটে গিয়ে ঘুড়িটা হাতে নিতেই নিচে তাকিয়ে দেখি লিকলিকে ধরনের আমার সমবয়সী একটা ছেলে চিৎকার দিয়ে বলছে ওটা আমার ঘুড়ি, ওটা আমার ঘুড়ি
দৌড়ে নিচে গিয়ে দরজা খুলে ওর সামনে দাঁড়াতেই অপরাধীর মত আমাকে বললওটা আমার ঘুড়ি
ছেলেটা উচ্চতায় আমার সমান কিন্তু চেহারায় অপুষ্টির কারণে আমার থেকে আরো বেশি বয়েসী মনে হচ্ছিলছেড়া হাফপ্যান্ট একহাতে ধরে আমার দিকে একহাত বাড়ায়ে ছিলসে ধরেই নিয়েছিল আমি তাকে ঘুড়িটা দিব নাএকটা বিনয়ী ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকায়ে ছিল আমি ঘুড়িটা তার হাতে দিতেই
ভয় পাওয়া হরিণের মত দিল এক দৌড়আমি তাকে পেছন থেকে ডেকেই যাচ্ছিলামএই শোন,এই শোন?”
তার পেছন দিকে তাকাবার কোন অবকাস নেইনিমিষের মধ্যে উধাও হয়ে গেল ছেলেটাআমি আগের মত ছাঁদে গিয়ে ড্রইং করতে বসলামমন থেকে কিছুতেই ছেলেটার দৌড় সরাতে পারছিলাম না আমাকে দেখে এমন দৌড় দেওয়ার কারণ কী?ওর কথা চিন্তা করতে করতে এক প্রকার দিনটা কেটে গেল আমারপরের দিন ছাঁদে দাঁড়িয়ে ওর দৌড়ের পথের দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণওকে এর পরের কয়দিনে আর পাওয়া গেল নাএকদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে রাস্তার ধারে দেখি একটা ছেলে কাঁধে বস্তা নিয়ে কাগজ কুড়াচ্ছেআমার চিনতে বাকি রইল না এই সেই ছেলে যে আমার হাত থেকে ঘুড়ি নিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিলআমি ড্রাইভার আঙ্কেলকে বলে জীপ থামিয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালামসে ততক্ষণে আমাকে চিনতে পেরেছেআমাকে নামতে দেখে সে আবার তার ঝুলে পরা প্যান্টটা বাম হাতে চেপে ধরে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলআমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
তুমি সেদিন দৌড় দিলে কেন?
ছেলেটা কোন কথা বলল নামাটির দিকে তাকিয়ে রইলআমি এবার আস্তে তাকে বললাম
তুমি আমাকে একটা ঘুড়ি বানিয়ে দিবে?
মুখে কিছু বলল না তবে মাথা ডান দিকে অনেকটা হেলিয়ে সম্মতি জানাল
কাল তুমি আসবে কিন্তুআমি এখন চলে যাচ্ছি
আবার একই ভাবে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালআমি বাসায় চলে আসলামতখন আর আমার কিছু ভাল লাগছে নাকাল কখন হবেকখন ছেলেটার থেকে ঘুড়ি বানিয়ে নেবআচ্ছা ছেলেটার নাম কি?কাল আগে তার নাম জিজ্ঞেস করতে হবে
পরেরদিন স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগ রেখে আগে ছাঁদে উঠলামদেখি কিছুটা দূরে ছেলেটা হাতে কঞ্চি আর একটা চাকু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপআমি ডাকতেই আমার গেটের দিকে চলে আসল ওকে ছাঁদে নিয়ে আসলামওর মুখে কেন জানি আর আগের মত ভয়ের চিহ্ন নেইআমার সাথে খুব সহজ ভাবে মিশছে
তোমার নাম কি রাফি?
আশ্চর্য এই ছেলেটা আমার নাম জানে কিভাবে
সেদিন ড্রাইভার তোমারে রাফি বলে ডাকছিল ওখান থেকে তোমার নাম জানিআমার নাম ইদ্রিস যে তালগাছটা দেখছো তার ওপারে রেললাইনের সাথে আমাদের বস্তিএকটু কাগজ আর আঠা দাও?
তুমি কাগজ কুড়াও কেন?স্কুল যাও না
নাস্কুল যাইতে ভাল লাগে নাআর কাগজ কুড়াই প্যাটের দুঃখে
প্যাটের দুঃখেসে এমন ভাবে বলছিল যেন সে এক দক্ষ কর্মজীবী বালকপেট ছাড়া সে আর কিছু বোঝে না
আমি তাকে কাগজ এনে দিতেই সে খুব সুন্দর ফ্রেম তৈরি করে ফেললচোখের এক কোনায় নিয়ে মাফজোখ ঠিক করে দেখলতারপর একটু উড়িয়ে আমার হাতে দিয়ে বললদারুন হইছে রাফি ভাইএকদম চিলের লাহান উরবো খালি আকাশ বাও পাইলে
আকাশ বাওমানে মাটির চেয়ে আকাশে অনেক বেশি বাতাস থাকে এটা আমি তার কাছ থেকে পরে শুনেছিতার কাছ থেকে এমন আরো অনেক শব্দ শিখেছি যেগুলো আগে কখনও জানতাম নাকাউয়ার কুলিনামে একধরনের ছোট ফলের নাম শুনেছি যেটা বাঁশের খোলা চোঙ্গার দুই মাথায় দুইটা দিয়ে একপাশ থেকে চাপ দিলে বন্দুকের মত কাজ করে
ঘুড়ি বানিয়ে আমরা উড়াতে গেলামঅনেকক্ষণ ঘুড়ি উড়ালামঘুড়ি আমি আগে কখনও উড়াইনিএত মজা লাগত ইদ্রিস এর সাথে ঘুড়ি উড়াতে তার পুর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ঘুড়ির অনেক আচরণ বিধি বলতে পারতঘুড়ি উড়তে উড়তে যেকোন একদিকে কাঁত হলে সুতা ঢিলা করতে হবে কারণ তখন আকাশ বাওবেশিআবার ঘুড়ি কম উড়লে নামায়ে ঘুড়ির নাভিতে প্যাঁচ দিতে হবেকম বাতাস হইলে লেজ ছোট রাখতে হবেঘুড়ির মতি বুঝে নামাইতে হবেনাহলে সুতা ছিঁড়ে যেতে পারেএভাবে ঘুড়ি উড়ানোর সব কৌশল আমি ইদ্রিস এর কাছ থেকে রপ্ত করে নিয়েছিলামইদ্রিস প্রতিদিন আমাকে একটা করে ঘুড়ি বানিয়ে দিত আর সেটা নিয়ে আমরা সারা বিকেলভর উড়াতামএকদিন আমাদের ঘুড়ি মেঘের কাছাকাছি চলে গেছেদুজনের উত্তেজনার আর শেষ নেইআরো সুতা ছাড়িমেঘ মাঝে মাঝে ঘুড়িটাকে ঢেকে দিচ্ছেএদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছেঘুড়ি নামানোর নাম নেইইদ্রিস পাশে থাকলে যেন আমার সাহস অনেক বেড়ে যেতএমন সময় ঘুড়ির সুতো গেল ছিড়েইদ্রিসসুতা ছিড়ছেবলে দিল এক দৌড়আমি তার পিছে পিছে দৌড় দিলামঘুড়ির দিকে তাকিয়ে আমরা দুজনে ছুটছি আর ছুটছিসেদিন কোথায় গিয়েছিলাম জানি নাআমি দৌড়াতে দৌড়াতে অজ্ঞান হয়ে পরেছিলামজ্ঞান ফিরে দেখি আমার মাথার কাছে মা বসে আছেনএর পরের কয়েকদিন ইদ্রিস আর আসল নাতার বাসাও চিনি নাতার কোন খোঁজ আমার কাছে নেইইদ্রিস ছাড়া আমি যেন আরো অসুস্থ হয়ে পরছিএর কয়েকদিন পরেই আবার বাবার ট্রান্সফারের নোটিস হলতখন আমার অবস্থা দেখে কে?ইদ্রিস ছাড়া আমার যেন চলবেই নাআমি মাকে প্রতিরাতেই বলতামআচ্ছা মা বাবার ট্রান্সফার কেন হয়?ট্রান্সফার হলে শুধু আমাদের কয়জনের যেতে হবে কেন?আমাদের চারপাশের সবাই আমাদের সাথে কেন ট্রান্সফার হয় না?”
মা আমার প্রশ্নের যেসব উত্তর দিতেন তার কোনটারই আমি ভিত্তি খুঁজে পেতাম নাআমি কি খুব কঠিন প্রশ্ন করিবারবার আমার এটাই মনে হতইদ্রিস এর সাথে আমার আর দেখা হয় নিমাঝে মাঝে ইদ্রিস কে স্বপ্নে দেখতামবাঁয়ে কাটান রাফি ভাই,ডানপাশে বাতাস বেশি
আজ এই ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে আমার ইদ্রিস এর কথা খুব মনে পরছেআমার মনে হচ্ছে ইদ্রিসও কোন এক জায়গা থেকে এই ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে আছেআমার সাথে তার চোখাচোখি হচ্ছে এই ঘুড়ির মাধ্যমে   

১৫/০৭/২০১২, রাজশাহী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন