রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি,শিলাইদহ।উৎসঃ google.com |
রাজশাহী থাকলে
কুষ্টিয়া যাওয়া বাধ্যতামূলক।কিন্তু কোন এক অজ্ঞাতকারণে সারাদেশ ঘোরা হলেও কুষ্টিয়া
বাকিই থেকে গেল।কাছেই বলে বন্ধুদের কারো গায়ে লাগে না।শেষমেষ রাজশাহী থেকে বিদায়
নেয়ার কিছুদিন আগে আমি ভালমতই জেঁকে বসলাম।এবার কুষ্টিয়া যাবই যাব।আর না যেয়েও
উপায় নেই।বন্ধু হোসেন কুষ্টিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে প্রতিমাসে দুইবার করে আসছে
রাজশাহী ভালবাসার টানে।প্রতিবারেই যাওয়ার সময় আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য উঠেপরে
লাগে।তাই বন্ধুর আবদার রক্ষার্থে হলেও একবার কুষ্টিয়া যাব।কুষ্টিয়া আমাকে যেতেই
হবে।কেউ মানুক আর না মানুক কুষ্টিয়া শহর কে আমি সুরের শহর বলি।A city of tone.যেখান থেকে এত
গান এত কবিতা,ছন্দের উৎপত্তি তার নাম যদি সুরের শহর হয় তাহলে বলা বাহুল্য হবে না।
সকাল সাতটা
দশের ট্রেনে রওনা দিলাম আতিক,রাশেদ,হোসেন আর আমি।সকালে ট্রেন ভ্রমন আমার কাছে
সবসময় আনন্দের।আর শীতের সকাল হলে তো কথায় নেই।জবু থবু হয়ে থাকা ফসলের মাঠের ওপার
থেকে সূর্য উঠি উঠি করেও ঠিক ওঠার জন্য উপযুক্ত মানসিক শন্তির অভাবে যেন নিজের
অবস্থানেই স্থির হয়ে আছে।কোথাও বাড়ি কোথাও মাঠ ।এক এলাকা থেকে আরেক এলাকা।কোথাও
উঠানে মেয়েরা হাড়িপাতিল মাজছে আবার কোথাও ছোট্ট ছেলেমেয়েরা ট্রেনের সাথে কিছুদূর
দৌড় দিয়ে আবার থেমে যাচ্ছে।কোথাও পার্শ্ব রাস্তা আটকিয়ে দেওয়ার ফলে যানবাহনের
দীর্ঘ সারি তৈরি হয়েছে।লোকজনের চোখে বিরক্তি।আমার কিন্তু কিছুই খারাপ লাগছে
না।আব্দুলপুর জংশনে হালকা চা নাস্তা খেয়ে আবার ট্রেনে চাপলাম।কিছুটা চাঞ্চল্য লক্ষ
করা যাচ্ছে।ঘুমন্ত মানুষগুলো জেগে উঠেছে।আমার সহপাঠীরাও এতক্ষণ ঘুমিয়ে
ছিল।প্রকৃতির চাঞ্চল্যে তারাও এখন চঞ্চল।গল্প শুরু হল হোসেন কে পঁচানোর মধ্য
দিয়ে।সে যে সময়ের কথা বলেছিল তার থেকে বেশি সময় লাগছে আমাদের পৌঁছাতে।বেলা ১০ টা
নাগাদ কুষ্টিয়া নেমে চারপাশ ঘুরে দেখতে লাগলাম।শুক্রবার দিন।মার্কেট বন্ধ থাকায়
শহরের রাস্তাগুলো ফাঁকা।সময় বেশি নষ্ট না করে রওনা দিলাম শিলাইদহের
উদ্দেশ্যে।শিলাইদহ নামটা আমার কাছে অন্য রকম।একটা মাহাত্ম্য বহন করে।শ্রদ্ধাভরে
হৃদয় আপ্লুত হয়ে যায়।যাওয়ার পথে চারপাশের গ্রামগুলো আমার কাছে ছবির মত মনে হতে
লাগল।সেই ছবির মাঝখানে বসে আছেন জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।তাঁকে ঘিরে গ্রামের
মূর্খ লোকগুলি তাদের অভিযোগ অনুযোগ জানাচ্ছে।কবি গম্ভীর হয়ে শুনছেন সবকিছু।কিছুদূর
পরে রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নদী।আমি সেখানেও গুরুকে দেখতে পেলাম।গুরু পদ্মা
বোটে মাঝনদীতে চুপ হয়ে বসে আছেন।আকাশ মেঘে ঢাকা থাকার কারণে চাঁদ দেখা যাচ্ছে
না।মেঘের গর্জন মাঝে মাঝে চারপাশ ছাপিয়ে তুলছে।বিদ্যুতের ঝলকানি বহুদূর পর্যন্ত
শূন্য থেকে মহাশূন্য কবির সামনে মেলে ধরছে।কবি লিখছেন
“গগণে গরজে
মেঘ ঘন বরষা,
কুলে একা বসে
আছি নাহি ভরসা।“
দুপুরে গুরুর
কুঠিবাড়িতে প্রবেশ করলাম।চারপাশ ঘুরে দেখছি।রবীন্দ্রনাথ এর স্মৃতি বিজরিত
গাছ,পুকুর,রাস্তা।হাঁটতে হাঁটতে কার যেন পদশব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি।উনি আমার আগে আগে
ধীর পায়ে হেঁটে চলেছেন।হাতের লাঠির ঠকঠক আওয়াজ হচ্ছে।এই যে এই গাছটা আমি নিজ হাতে
লাগিয়েছি।তিনি বিরবির করে বলে চলেছেন-
“যেমন আছ
তেমনি এসো, আর কোরো না সাজ।
বেণী নাহয়
এলিয়ে রবে,সিঁথে নাহয় বাঁকা হবে,
নাই-বা হল
পত্রলেখায় সকল কারুকাজ।“
পরেছিস রে
হতচ্ছাড়া,কবিতাখানা?
আমি ধীরে ধীরে
মাথা নাড়লাম।আমার অনেক পছন্দের একখানা কবিতা।বললাম না পছন্দের।পরে আধিখ্যেতা হয়ে
যায়।
এইখানে বসে লিখেছি।বস
এইখানে।
আমি
বসলাম।গুরু দূরে কোথায় যেন তাকিয়ে আছেন।মহাশূন্যে?নাকি শতবর্ষ পরে।
-হ্যা রে তুই
কবিতা পড়তে জানিস।
আমি মাথা
ঝাঁকালাম।
-“১৪০০ সাল”
কবিতা তোর জন্য লিখেছিলাম।পড়েছিস?
আমি আবার মাথা
ঝাকালাম।কবির পাশে বসে “১৪০০ সাল” কবিতাটি পড়ার লোভ সামলাতে পারলাম না।
“আজি হতে
শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ
বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহলভরে।
আজি হতে
শতবর্ষ পরে!”
আরো কয়েকটা
কবিতা পড়লাম এলিয়ে পরা সূর্যের আলোয় আমগাছের ছায়ায় বসে।কবিতা পড়া শেষ হলে দেখলাম
কবি পুকুরপাড়ের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন।আমি ওনার পদাঙ্ক অনুসরণ করলাম।পেছন থেকে আতিক
ডাকছে বাড়ীর ভেতরে প্রবেশের জন্য।কবি কোথায় গেলেন আর খুজে পেলাম না।দেরি না করে
কবির সেই মনোরম স্নিগ্ধ কুঠিবাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলাম।ভয় ভয় করছিল না জানি কবি
আমার কোন আচরণে বিরক্ত হোন।খুব সাবধানে এদিক ওদিক ঘুরেফিরে দেখছিলাম।শিলাইদহে বসে
লিখা কবিতাগুলো একে একে পড়ছি।ঐতো ওনাকে দেখা যাচ্ছে সপরিবারে বসে খাবার
খাচ্ছেন।কবির শোবার ঘরে গেলাম।কবির ব্যবহৃত খাটখানি সংরক্ষিত আছে।খাটের একপাশে
দাঁড়িয়ে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি কবি একপাশে হেলান দিয়ে আপন মনে গেয়ে চলেছেন
“তোমায় গান
শোনাব,তাইত আমায় জাগিয়ে রাখ।
ওগো দুখ জাগানিয়া
তোমায় গান শোনাব।”
দের ঘন্টা
কবির একান্ত কাছে থেকে ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম।আমি আর আমার মধ্যে নেই।আমি এখন
সবখানে গুরুকে দেখতে পাচ্ছি।কখনও চিলেকোঠায়,কখনও বাসার সামনের উঠানে,কখনও বা পুকুরপারে
গাছতলায়।কবির সমস্ত ছোয়া,ওনার ভাললাগা মিশে আছে এই শিলাইদহের মাটিতে।দুপুর গড়িয়ে
বিকেল।কবির পছন্দের দিঘিতে ওনার সবচেয়ে প্রিয় পদ্মা বোট খানা রাখা আছে।তারি পাশে
বসে আছে একদল গাইয়েন।শুনতে চাইলাম ওনারা কখন গান করেন?উত্তরে অধিকতর বিনয়ের সাথে
অন্ধ বৃদ্ধ জানাইলেন কেউ শুনতে চাইলেই কেবল তারা গুরুর গান গান।যেই গানগুলি কবি
এখানে বসে থেকে লিখেছেন।তিনি শুরু করলেন “যখন পরবে না মোর পায়ের চিহ্ন এই ঘাটে”
দিয়ে।একে একে গেয়ে চলেছেন।তারপর শুরু করল ওনার ছেলে ।আমি শুনতে চাইলাম “এসো
নিপোবনে ছায়াবীথি তলে”।ছেলেটি গাইল।অসাধারণ কন্ঠ।তার পর শুনতে চাইলাম “তুমি কি
কেবলি ছবি” সেটাও গাইল।প্রায় দশটা গান গাওয়ার পর যখন শেষ গানটি গাচ্ছিল “আমার মন
মানে না” কান্না ধরে রাখতে পারলাম না।গুরুর গাছতলায় বসে গুরুর গান শুনছি এর থেকে
আনন্দের আর কি হতে পারে।গানশেষে পারিশ্রমিক দেওয়ার সময় যখন বললাম আপনারা
মহান।গুরুকে ধারণ করে আছেন নিজের মধ্যে।কয়জনই বা পারে। তখন অন্ধ বৃদ্ধটি আমার হাত
ধরে কাঁদতে লাগলেন যিনি বিশ বছর ধরে কবির গান গেয়ে দিনযাপন করছেন।ততক্ষনে দিনের
আলো নিবে আশার অবস্থা।ওনাদের থেকে বিদায় নিয়ে ধীর পায়ে বাইরের দিকে অগ্রসর
হচ্ছি।বের হবার আগে আরেকবার কবির উপস্থিতি লক্ষ করলাম।উনি আমবাগানে বসে কি যেন
লিখছেন।মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি কবির দিকে।ইনিই সেই কবি যিঁনি একশো বছর আগে জানতেন
শতবর্ষ পরে ওনার কবিতা আমি ওনাকে পড়ে শোনাব।যিঁনি আমাকে অনেক ছোটবেলায় বীরপুরুষ
বানিয়েছেন।যাঁর বিষ্টি পরে টাপুর টুপুর কবিতা পড়লে আমাদের একসাথে আনন্দ আর ব্যথা
জাগ্রত হয়।যিঁনি আমাকে একলা চলতে শিখিয়েছেন।যিনি পাতার ভেলা ভাসিয়েছেন যুগ থেকে
যুগান্তরে।কাগজের নৌকা পানিতে ছেড়ে তার গতিপথের সাথে সমগ্র বাঙ্গালি শিশুর
নিরুদ্দেশ যাত্রার স্বাদ পাইয়েছেন।ভালবাসতে শিখিয়েছেন অভিজাত কায়দায়।যিঁনি প্রেমিক
প্রেমিকার মন নিয়ে খেলেছেন হাজার হাজার পৃষ্ঠা দিয়ে।যাঁর উপস্থিতি বাংলা সাহিত্যকে
দিগুণ করেছে।সেই কবি লিখছেন।তিনি সময়কে বেঁধে ফেলছেন শব্দে।আবেগকে আরো গভীর করে
বাড়িয়ে তুলছেন ছন্দ দিয়ে।কুঠিবাড়ি থেকে বের হয়ে বুঝলাম মনের খোরাক মিটলেও পেটেরটা
মেটেনি।সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি।একটা অটোরিক্সা ঠিক করে কুষ্টিয়া শহরের দিকে রওনা
দিলাম।ছেড়ে যাচ্ছি শিলাইদহ।নিয়ে যাচ্ছি ব্যথা।এই ব্যথা প্রকাশ করার মত ভাষা আমার
জানা নেই।শুধু জানি কিছু কিছু ব্যথা সুখের মত লাগে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন