শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

ছেলেটা


হুট করেই ভার্সিটি বন্ধ হয়ে গেল।অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ।কেন বন্ধ হল নদী কিছু জানে না।হলে থাকলে হয়ত জানতসে হলে থাকে না।রাজশাহী শহরে তার মামা মামী থাকে।অনিচ্ছা সত্বেও তাকে মামা মামীর বাসায় থাকতে হয়।বাসা থেকে হল এ থাকতে বারণ।হল এ অনেক মেয়ে একসাথে থাকে , আড্ডা গল্প করতেই সব সময় শেষ মেয়ে পড়বে কখন।এমন একটা বদ্ধমূল ধারণা আকড়ে থাকে নদীর পরিবার।আগে মামা মামীর বাসায় ঘুরতে এলে একদিনের বেশি থাকতে পারত না।আর এখন সেখানেই দিনের পর দিন থাকতে হচ্ছে।অন্যের বাসায় এভাবে দিনের পর দিন থাকতে ভাল লাগে না।মামা মামী অনেক আদর করে নদীকে কিন্তু তবুও কোথায় যেন একটা সংকোচ থেকেই যায়, নিজের মত করে থাকা যায় না।মাঝে মাঝেই মনটা খারাপ হয়ে থাকে।কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
আজ সকাল থেকে তার মনটা কেমন যেন হয়ে আছে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসায় তার ঠিক হয় নি বারবার মনের মধ্যে এমন একটা দ্বিধা কাজ করছে। ক্লাসে কিছু বোঝে না সে। স্যার রা কি পড়ান আজ ছয় মাস হয়ে গেল কিছুই ধরতে পারে নি। নিজেকে খুব অপরাধী লাগে। কি হচ্ছে তার সাথে এসব। এর মধ্যে আবার রিমা ফোন করে বলল ভার্সিটি নাকি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ। কেন বন্ধ কেউ সঠিক জানে না। তবে খুব তারাতারি হল ভ্যাকেন্ট করতে বলেছে। সবাই বাসায় চলে যাচ্ছে। নদী কি বাসায় যাবে?আরো একটা দ্বিধা মনে উদয় হল। ভার্সিটি বন্ধ হলে বাসায় তো যেতেই হবে কিন্তু নদীর বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। কেন ইচ্ছে করছে না সে জানে না।
ভার্সিটি মানে নতুন জীবন,নতুন অনুভূতি এই কথা যেন সম্পূর্ণ গাঁজাখুরি। সব আগের মতই আছে।ইন্টারমিডিয়েটে পড়তে কত স্বপ্ন ছিল ভার্সিটিতে ভর্তি হলে ইচ্ছেমত যা খুশি করব। সারাদিন ঘুরাঘুরি আর আড্ডা দিয়ে পারি দিব। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হল না। আগে বাবা বাইকে করে কলেজে রেখে আসতেন আবার নিয়ে যেতেন এখন মামা রেখে আসেন ভার্সিটিতে। ইচ্ছেমত সবকিছু করা যায় না। নিজের কাছে নিজেকেই বোঝা মনে হতে থাকে।
অনিচ্ছা সত্বেও ফোনটা হাতে নিয়ে ফেসবুকে চোখ বুলায় নদী। সবসময় লগ ইন করা থাকে। শুধু মিনিমাইজ বাটনে চাপ দিলেই অটো লোড হয়ে যায় নিউজ ফিড। ইদানিং ফেসবুকে আসক্তি যেন বেড়ে যাচ্ছে। দিনের অধিকাংশ সময় ফেসবুকের পেছনেই যায়। তেমন চ্যাটও হয় না কারো সাথে।শেষ কবে স্ট্যাটাস আপ্লোড করেছে নিজেরই মনে নেই।সবার নিউজফিড দেখতেই ভাল লাগে। কে কি করছে,কার সাথে কার রিলেশন হল,কার সময় ভাল কাটছে কার বোরিং কাটছে এসব দেখতেই সময় কোনদিক দিয়ে চলে যায় টেরই পায় না। দিনশেষে মনে হয় কাজের কাজ কিছুই হয়নি শুধু শুধু সময় নষ্ট। তবে এখন অনেক সময় নদীর হাতে। ফেসবুকই একমাত্র ভরসা সময় কাটানোর।নিউজফিডের প্রথমেই যার স্ট্যটাস চোখে পরে তার নাম নীল চত্ত্বর। অবশ্যই ছদ্য নাম। তবে লোকটা অচেনা নয়। ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই।মাঝে মাঝে অনেক ভাল স্ট্যাটাস দেন। উনার অনেক স্ট্যাটাস পড়েই কতবার যে হেসে গড়াগড়ি খেয়েছে নদী তার হিসেব নেই। অনেক সময় মন ভাল করা স্ট্যাটাস দেন।পড়লেই সাথে সাথে মন ভাল হয়ে যায়। গল্পও লিখেন মাঝে মাঝে। তবে এখন যেই স্ট্যাটাস চোখের সামনে আছে সেটা অনেক বিরক্তি কর। এমন লোক এই ধরনের স্ট্যাটাস কিভাবে দেন। তারপর আবার ভার্সিটির সিনিওর ভাই। পারসোনালিটি বলে কি কিছু নেই? স্ট্যাটাসটা আন্ডারওয়ার নিয়ে। কাজ কাম নাই তাই ফ্রেন্ডদের সাথে আন্ডারওয়ার কিনতে গেছেন। একেকজন একেক কালার চয়েস করে দিচ্ছেন আর উনি মজা নিচ্ছেন। আর তার কমেন্টগুলা কি? ছিঃ পড়লেই বমি আসে। ফালতু লোক একটা।
প্রতিদিন দশটা পঁঞ্চাশ এ ক্লাস আড়ম্ভ হয়।তার আগেই সবাই ক্লাসরুমে ঢুকে পরে। সিনিওর ভাইয়া আপুরা ক্লাসের পাশ দিয়েই যাতায়াত করেন। সবার যখন ক্লাস শুরু হইছে  অমনি একটা ছেলে কাঁধে কাপড়ের একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে হনহন করে ছুটছে। ক্লাস শুরু হওয়ার পর বারান্দা যখন খালি থাকে তখন কেউ একজন হেঁটে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই সবার মনোযোগ কেরে নেয়। ব্যাগ এ কিছু আছে বলে মনে হয় না।একটা খাতা থাকলেও থাকতে পারে। ঝোলার মত একটা ব্যাগ তার ওপর যত কবি সাহিত্যিকের ছবি আঁকা। দেখে মনে হয় চারুকলায় পড়েন। চেহারাটাও মাশাল্লা। চোখে মোটা ফ্রেমের একটা চশমা এটেছেন, মাথায় মনে হয় চিরুনি কবে লাগিয়েছেন নিজেও জানেন না। ঢিলা শার্ট অথবা টি শার্ট পরেন সবসময়।
সবমিলিয়ে একটা উড়াধুরা ভাব।পরিপাটির নাম গন্ধ নেই তবে হাঁটাচলার মধ্যে কেমন একটা স্মার্টনেস। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। এভাবে প্রতিদিন চোখে পরে ভাইয়াটাকে। একদিন ফেসবুকে “পিপল ইউ মে নো” অপশনে আনমনা আকাশ দেখা একটা ছেলের প্রোফাইল ফটো সম্বলিত সেই উড়াধুরা ছেলেটার আইডিও পেয়ে যায় নদী। কি যেন ভেবে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টও পাঠিয়ে দেয়।রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট হয় না। এক দিন যায় দুদিন যায় এভাবে কয়েকটা দিন কেটে গেলে ছেলেটার কথা প্রায় মনেই থাকে না নদীর। তারপরেও কত বার দেখা হয়েছে। সেই একই ভাব। সবার ক্লাস শুরু হলে হনহন করে যাচ্ছেন উনি। আনমনা দৃষ্টি দিয়েই আবার ফেরত আনার চেস্টা সাথে সাথে। তবে একদিন খুব ভাল করে দেখেছিল নদী নীল চত্তর নামের সেই ভাইয়াটাকে। দূর থেকে চায়ের টং এ বসে হাত নেড়ে নেড়ে কি যেন বলছে সবাইকে আর হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। সে কি উচ্ছ্বল হাসি। অনেক দূর থেকে হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এমন গম্ভীর প্রকৃতির লোক এমন করে হাসতে পারে নদীর জানা ছিল না। সেই হাসির কোথায় যেন একটা মুক্তির স্বাদ। নদী এতদিন বাবা মা তারপর মামা মামীর শাসনে যেই মুক্তির স্বপ্নই দেখেছে সবসময় তেমন একটা উদাসীন হাসি। যার কোন পিছুটান নেই বন্ধন নেই সেই কেবল এমন করে হাসতে পারে। ভাইয়াটাকে নদীর খুব ভাল লেগে যায়।তার হাসির আড়ালেই নিজের মুক্তি খুঁজে নেই যেন। নদী কি ছেলেটার প্রেমে পরেছে? না অসম্ভব। নদী কখনও প্রেমে পরতে পারে না।প্রেম শব্দটা তার সাথে যায় না।ইন্টারমিডিয়েটে খুব কাছের একটা বান্ধবীর ব্রেকআপ হওয়ার চাক্ষুস সাক্ষী নদী। প্রেমে ব্রেক আপ হলে এতটা কষ্ট পেতে হয় সেটা সে খুব কাছ থেকে দেখেছে। অন্যের জন্য নিজেকে এত কষ্ট কেন পেতে হবে তার উত্তর সে পায়নি। তারপর থেকে শপথ এঁটেছে।জীবনে সবকিছু করব তার মধ্যে প্রেম কেন? তার জেদ এতটায় প্রবল ছিল যে অনেক প্রেমের প্রস্তাব পেয়েও নিজেকে  তার শপথে অবিচল রেখেছে।তবে আজ কেন এই ব্যর্থতা?
না এটা ব্যর্থতা নয়।কাউকে ভাল লাগতেই পারে তাই বলে তার প্রেমে পরতেই হবে এমন তো কিছু নয়।তবে সেই হাসিটা।সেই মুক্তির স্বাদ যেন ছেলেটার কথা মনে করিয়ে দেয় নদীকে।এরপর থেকে ক্লাসে যখন হনহন করে যাচ্ছেন উনি
নদীর দৃষ্টিও যেন তার সেই উড়াধুরা স্টাইলেই আটকা পরে।একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।তারপর একদিন রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট হয়।নদী চ্যাট এ নক ও করে কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারে না।দু একটা কথা বলে কোথায় যেন হারিয়ে যায়।এখানেও এমন ডোন্ট কেয়ার ভাব।নদী আর নক করে না।ছেলেটাও করে না।মাঝে মাঝে স্ট্যাটাস আপ্লোড দিলে নদী খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে।একবার দুবার করে বহুবার পড়ে ফেলে।কিভাবে এত সাজিয়ে গুছিয়ে একজন লিখতে পারেন নদীর বোধগোম্য হয় না।কতবার স্ট্যাটাস দিতে গিয়ে ভাষা হারিয়ে ফেলেছে নদী।শেষমেষ কোন স্ট্যাটাসই দেয় না।তবে মাঝে মাঝে মেজাজ চরম খারাপ হয় ভাইয়াটার ওপর ।এমন বাজে বাজে কথা লেখেন স্ট্যাটাসের মধ্যে পড়লেই গা ঘিনঘিন করে।এখন এমনটা হচ্ছে নদীর সেই আন্ডারওয়ার সম্বলিত স্ট্যাটাস টা পড়ার পর। যদি বলতে পারত কোনভাবে আপনি আর এমন স্ট্যাটাস দিবেন না। আপনার স্ট্যাটাস কেউ একজন খুব যত্ন করে পড়ে। সবকিছুর পরেও ভাইয়াটাকে ভাল লাগত।এই কাটখোট্টা পড়াশুনার মাঝে তার দিকে তাকালেই একটা উদাসীনতার আঁচ পাওয়া যেত। তার সেই ঝোলানো ব্যাগ,রুক্ষ চেহারা,আর গাম্ভীর্য মিলিয়ে কেমন যেন একটা ক্যারেকটার। ভাল লাগলেও কাছে যাওয়া যায় না। একটা বেস্টনি যেন চারপাশে তৈরি করে রেখেছেন। অনেক ভেবে নদী বের করেছে নীল চত্ত্বর মানে আকাশ। উনি কি তবে আকাশের মত? এসব ভাবতে আর ভাল লাগে না। তার কিছুতেই বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না।একটা শব্দই তার মনে উদয় হচ্ছে অনির্দিষ্টকাল বন্ধ।এই অনির্দিষ্ট কাল কিভাব কাটাবে নদীর মুক্তির স্বাদ ছাড়া?

 ২৫/০৩/২০১৪, রাজশাহী


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন